তামাক পণ্যে উচ্চ হারে কর বাড়ানো দরকার
বিশ্বে সবেচেয় বেশি তামাক ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। এদেশে জনগণ সিগারেট-বিড়ি ধূমপানের পাশাপাশি জর্দা, গুল, সাদা পাতার মতো ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যও ব্যবহার করে। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৫.৩% (৩ কোটি ৭৮ লক্ষ) প্রাপ্তবয়স্ক (১৫ বছর বা তার বেশি) কোনো না কোনো প্রকার তামাক ব্যবহার করে। তামাক ব্যবহারের প্রবণতা শহরাঞ্চলের তুলনায় (২৯.৯%) গ্রামাঞ্চলে বেশি (৩৭.১%)।
তামাক ব্যবহারের এই উচ্চ হার জনস্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং একই সাথে আমাদের উন্নয়নযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কোনো দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অবশ্যই জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, সুস্থ মানুষের শ্রমের বিনিময়েই দেশ সমৃদ্ধ হয়। এজন্যই জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) লক্ষ্য ৩-এ সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের জীবনাচরণ ও অভ্যাসজনিত কারণে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব রোগের পিছনে বড় একটি কারণ তামাক ব্যবহার।
দেশে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব ১৮ শতাংশ মানুষ ধূমপান করে। বিপুল পরিমাণ তামাক সেবনের ফলও ভয়াবহ। প্রতিবছর দেশে তামাকজনিত রোগে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায়। অন্যদিকে তামাক ব্যবহারের ফলে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা ও উৎপাদনশীলতা নষ্ট হওয়ার কারণে প্রতিবছর দেশে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়াও তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, তামাকপণ্য উৎপাদন, কৃষি জমির উর্বরতা হ্রাস, বিড়ি/সিগারেটের ধোঁয়ার পরিবেশগত ক্ষতি রয়েছে। সামগ্রিকভাবেই তামাক জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য বড় একটি হুমকি।
তামাকের এই ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনায় নিয়েই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে তামাকের ব্যবহার নির্মূল করার ঘোষণা দেন। তিনিই বিশ্বের প্রথম কোনো রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি এমন ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি শুধু দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণাই দেননি, বরং এই লক্ষ্য অর্জনে করণীয় সম্পর্কেও আলোকপাত করেছিলেন। তিনি এজন্য তামাক কর কাঠামো সংস্কার এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করার ওপর জোর দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নে নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে তামাকের ব্যবহার হ্রাস, তামাকের পরিবর্তে অন্য ফসল চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা, তামাক শ্রমিকদের অন্য কোনো ঝুঁকিমুক্ত পেশায় নিয়োজিত করা, তামাকে কর বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও চাহিদা কমানো, জনসাধারণকে তামাক ছাড়তে সহায়তার ব্যবস্থা করা প্রভৃতি পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় আন্তরিকভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নিলে অবশ্যই আমরা বাংলাদেশকে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত করতে পারবো।
কার্যকরভাবে করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের দাম বাড়ানো হলে তরুণ প্রজন্ম তামাকে আসক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে না। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের লোকজনও ব্যবহার কমাতে বাধ্য হবে। স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো পণ্যের দাম বাড়লে ধনীর তুলনায় গরিব মানুষের মধ্যে পণ্যের ব্যবহার হ্রাস পায়। একইভাবে তামাকপণ্যের দাম বাড়লেও নিম্নবিত্তরা তামাক ছাড়তে বাধ্য হবে। তবে তামাকের এই দাম বৃদ্ধি হতে হবে মূল্যস্ফীতি ও মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কোনো মানুষের আয় বৃদ্ধির তুলনায় তামাকের দাম কম হারে বাড়লে, সেই দাম তার পকেটে চাপ ফেলতে পারবে না। ফলে ব্যবহারও কমবে না।
এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য কর উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন। তা হলো- সিগারেটের মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরের প্রতি ১০ শলাকার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য যথাক্রমে ৮০, ১৩০ ও ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে ৬৫% সম্পূরক শুল্ক এবং নিম্ন স্তরের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার খুচরা মূল্য ৬০ টাকা নির্ধারণ করে ৬৩% সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। ফিল্টারযুক্ত বিড়ির ২৫ শলাকার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২৫ টাকা ও ফিল্টারবিহীন বিড়ির ২০ শলাকার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫%সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং প্রতি ১০ গ্রাম জর্দা ও গুলের খুচরা মূল্য যথাক্রমে ৫৫ ও ৩০ টাকা নির্ধারণ করে ৬০%সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং সকল তামাকজাত দ্রব্যের খুচরা মূল্যের ওপর ১৫% মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং ১% স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে তামাকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যহারে কমে আসার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পাবে; যা আগের বছরের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নে নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে তামাকের ব্যবহার হ্রাস, তামাকের পরিবর্তে অন্য ফসল চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা, তামাক শ্রমিকদের অন্য কোনো ঝুঁকিমুক্ত পেশায় নিয়োজিত করা, তামাকে কর বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও চাহিদা কমানো, জনসাধারণকে তামাক ছাড়তে সহায়তার ব্যবস্থা করা প্রভৃতি পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় আন্তরিকভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নিলে অবশ্যই আমরা বাংলাদেশকে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত করতে পারবো।