‘দেওরা’ গানের লুক তৈরির গল্প
দেশ-বিদেশে বেশ আলোড়ন তুলেছে কোক স্টুডিও বাংলার ‘দেওরা’ গানটি। একেকজন শিল্পী ও কলাকুশলীর বহুমুখী লুককে এক সুতায় গেঁথে এর দৃশ্যায়নে দারুণ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন কোক স্টুডিওর কস্টিউম টিমের নুজহাত খান, নুসরাত শ্রাবণী ও দিদারুল দিপু আর রূপসজ্জার সার্বিক দায়িত্বে থাকা ফারহানা চৈতী ও তাঁর টিম।
একদিকে হালের হার্টথ্রব গায়ক প্রীতম হাসানকে দেখে মনে হচ্ছে ‘নারুতো’ অ্যানিমে সিরিজ থেকে বাস্তব রূপ নিয়েছে বিখ্যাত চরিত্র কাকাশি হাতাকে। আবার গুণী শিল্পী ইসলাম উদ্দীন পালাকারের প্রথাগত চটকদার পালাগানের পোশাক ও রূপসজ্জার রগড়ও নজর কাড়ছে। নৌকাবাইচের সারিগানের দলের মাঝিমাল্লাদের গ্রামীণ সাজপোশাকে আবার শহুরে সোয়্যাগ। সঙ্গে রয়েছে ঘাসফড়িং কয়্যার নিয়ে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আরমীন মুসার ফিউশনধর্মী লুক। এ বলে আমায় দেখো, তো ও বলে আমায়। কোক স্টুডিও সিজন টুর সাড়া জাগানো গান ‘দেওরা’র সাজসজ্জা ও পোশাক পরিকল্পনার সংগীতায়োজনের মতোই বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময়। গানটির পরিবেশনায় আকর্ষণ আনতে এর নেপথ্যের মানুষগুলোর সুপরিকল্পনা আর পরিশ্রম মিশে আছে।
বেশ কিছুদিন ধরেই স্টাইলিংয়ের কাজ করছেন নুসরাত শ্রাবণী। সৌন্দর্যবিশেষজ্ঞ নুজহাত খান, দিদারুল দিপু আর শ্রাবণীর সমন্বয়ে তাঁদের টিম গানটির দৃশ্যায়নের দুই মাস আগে থেকেই এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিল। কোক স্টুডিওর প্রতিটি গানেই তা করেন তাঁরা। এখানে প্রীতম ও আরমিন মুসা কী পরতে চান, এ ব্যাপারে একটি পরিষ্কার ধারণা দিয়েছেন তাঁরা আগেই। প্রীতমের টার্টলনেক কালো টপ, ওপরের জলপাইরঙা বিশেষ ধরনের জ্যাকেট জনপ্রিয় অ্যানিমে চরিত্র কাকাশির মতোই অবিকল। স্নিকার্সে রিকশা পেইন্ট করা হয়েছে। করেছেন লাবেইবা পেইন্টিং অন র্যান্ডম স্টাফের কর্ণধার লাবিবা ইবনাত আলম।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, টি-শার্টের বাহুর অংশে রিকশা পেইন্টের স্টিকার। সচেতনভাবেই দেশীয় আমেজ আনতে তা রাখা হয়েছে বলে জানালেন শ্রাবণী। আর কি-বোর্ড বাজাবেন বলে হাতের হাইলাইট হিসেবে কালো স্টাইলিশ গ্লাভস রাখা হয়েছে প্রীতমের হাতে। হাউস ব্যান্ডে যন্ত্রসংগীত বাজাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের প্রত্যেকের পোশাকে গামছা প্রিন্টের প্যাচ দেওয়া।
গানের অন্যতম মূল শিল্পী ইসলাম উদ্দীন পালাকারের প্রথাগত লুকটিই ধরে রাখা হয়েছে এখানে। এ রকম পোশাক পরেই তিনি গান পরিবেশন করেন। অনেকটা ঝলমলে গোলাপি আনারকলি ধরনের এই পোশাকের সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে রয়েছে চুড়িসহ হাতে পরার বিভিন্ন গয়না আর পরিবেশনের অঙ্গভঙ্গিমায় ব্যবহৃত ওড়নাটি। ‘ভাবির সখী’ দুজনের শাড়ি সাতকাহনের। মানানসই ব্লাউজটি অবশ্য নিজেদের করা।
এদিকে ‘দেওরা’ গানটির স্রষ্টা ফজলু মাঝি ও মাঝিমাল্লার রূপে তাঁর দলটির লুঙ্গির সঙ্গে স্নিকার্স ও বেল্ট পরে শার্ট টাক-ইন করা স্টাইল নিঃসন্দেহে ফিউশনের মজা এনেছে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ পোশাকের স্টাইলিংয়ে। আর তা ফ্যাশনপ্রেমীদের চোখে পড়েছে দারুণভাবে। বিখ্যাত সংগীতশিল্পী আরমিন মুসার ধুতি স্টাইলে পরা ঝলমলে শাড়িটি ট্রেসি চিক থেকে নেওয়া। আরমিন ও পুরো ঘাসফড়িং কয়্যারের জ্যাকেট থেকে শুরু করে বাকি সব পোশাক সাতকাহন আর নিজস্ব টেইলারিং ও সংগ্রহ থেকেই নেওয়া হয়েছে।
এবার কোক স্টুডিওর সিজন টুর সাজসজ্জার সার্বিক দায়িত্বে রয়েছেন ফারহানা চৈতী। মেকওভার ফিনেস বাই ফারহানা চৈতী নামে তাঁর সৌন্দর্যসদনটি আধুনিক স্কিন ও হেয়ারকেয়ার আর রূপসজ্জার জন্য বলা যায় গ্রাহকদের পছন্দের তালিকায় উঠে এসেছে যাত্রা শুরু করার পর খুব দ্রুতই। আর এ জন্যই এবারের সিজনে কোক স্টুডিওতে পারফরম্যান্স-নির্ভর উপস্থাপনায় সঠিক লুক দিতে আস্থা রাখা হয়েছে ফারহানা চৈতীর ওপর।
‘দেওরা’ গানের এই বহুমাত্রিক অথচ দারুণভাবে একে অপরের মাঝে মিশে যাওয়া লুক তৈরির গল্পের চূড়ান্ত অধ্যায়টি তাঁর মুখ থেকেই জানা গেল। ফারহানা চৈতী আর তাঁর পুরো টিমের অক্লান্ত পরিশ্রম আর সুচারু পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিটি লুকের পেছনে। গানটির রূপসজ্জার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বললেন তিনি। প্রথমত, গানটির কথা, সুর, উৎস বা ধরন—এই সবকিছুর সঙ্গে সাজ সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। ‘দেওরা’ গানটি একদিকে যেমন সারিগান ধরনের লোকসংগীত, আবার বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে ফিউশনের আমেজে উপস্থাপন করা হচ্ছে তা। তাই সবার লুকও হতে হবে সে রকম।
এদিকে যাকে লুক দেওয়া হবে, তাঁকে যেন তাঁর মতোই দেখায়, এ বিষয়ও তিনি মাথায় রাখেন। কারও নিজস্বতা খর্ব করে লুক দেওয়ার পক্ষপাতী নন চৈতী। তাই প্রীতম বা আরমিন মুসার লুকে আকর্ষণীয় অনেক বিষয় থাকলেও তাঁদের বিশিষ্ট লুকের ব্যত্যয় ঘটেনি। প্রীতমের বিশেষ অ্যানিমে চরিত্রের মতো হেয়ারস্টাইল আর আরমিন মুসার গ্ল্যামারাস হেয়ারস্টাইল ও সাজ—এই সবকিছুই বৈচিত্র্য দিয়েছে ‘দেওরা’ গানের লুকে। এদিক দিয়ে অবশ্য ইসলাম উদ্দীন পালাকারের লুকটি খুবই নজরকাড়া হলেও খুব বেশি নিরীক্ষা করেননি চৈতী এখানে। প্রথা ও ঐতিহ্য মেনে তিনি যেভাবে গান পরিবেশন করেন, তাঁর লুকটিও সেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
খোলা চুলের স্টাইলিং, মেকআপে বেশিও নয়, কমও নয়—এমন ভারসাম্য রাখা হয়েছে সন্তর্পণে। ফারহানা চৈতী বললেন, টিভিতে পরিবেশনার জন্য মেকওভারের কাজটি আলাদাভাবে করতে হয়। কারণ, আলো পড়লে এতে যদি চকচকে লুক আসে, তবে তা ভালো লাগে না দেখতে। আর এই গানের সব কলাকুশলীর লুকের ক্ষেত্রেই তিনি অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে খুঁটিনাটি সব ডিটেইলস খেয়াল রেখে তাঁদের চূড়ান্ত লুক দিয়েছেন।
সামগ্রিকভাবে, কোক স্টুডিওর মতো একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ তা দেখবে—এই সবকিছু মাথায় রেখে নিজের সর্বোচ্চটাই দিয়েছেন ফারহানা চৈতী। আর তার ফল তো দেশ ও দেশের বাইরে সবার উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়াতেই দেখা যাচ্ছে।