https://www.bartomansylhet.com/

4009

economics

প্রকাশিত

২৪ এপ্রিল ২০২৩ ০২:৪৮

আপডেট

২৭ মে ২০২৪ ১২:৩৬

আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে শৃঙ্খলা ও সতর্কতা দরকার

চাঁদরাতে জ্যাকসন হাইটসে স্বদেশীদের মারামারি। ছবিঃ টিকটক ভিডিও থেকে নেয়া।বহুজাতি, বহু ধর্মের দেশ আমেরিকা। জন্মিশ্রনের এ ব্যাপকতার কারণেই দেশটি শ্রেষ্ট হয়ে উঠেছে। পরস্পরকে শ্রদ্ধা, সহসনশীলতা এবং সহমর্মিতাই আমেরিকার স্বকীয়তা এবং সৌন্দর্য। এ স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আমরা অহংকার করি। এ কারণেই সারা বিশ্বের লোক এখনও ছুটে আসে আমেরিকায়। বিশ্বের মানুষের কাছে অভিবাসনের সেরা গন্তব্য এখনও যুক্তরাষ্ট্রই। আমেরিকাই সেরা।   আমারা সকল দেশের সেরা, ধন ধান্য পুষ্প ভরা বাংলাদেশ থেকে এসে বিশ্বের সেরা দেশেই অভিবাসন করেছি। ফেলে আসা দেশ নিয়ে যেমন আমাদের গর্বের শেষ নেই, তেমনি বসবাসের দেশ আমেরিকায়ও আমাদের অহংকারের উচ্চারণ। এ দেশটির সব সুযোগ গ্রহণ করে আমাদের সম্মিলিত অর্জন এখনও নগণ্য। অভিবাসী হিসেবে বাংলাদেশীরা এখনও খুবই নগণ্য আমেরিকায়। যদিও নিউইয়র্কের মতো কিছুকিছু সিটিতে বাংলাদেশীরা এরমধ্যেই চিহ্নিত হতে শুরু করেছেন। নিজেদের ঐক্য আর সংযোগের কারণেই গত কয়েক বছর থেকে নিউইয়র্কের মতো মেগা সিটিতে বাংলাদেশীরা ব্যাপক আলোচনায় এসেছেন। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের গুরুত্ব বেড়েছে ব্যাপকভাবে। মেয়র থেকে শুরু কংগ্রেসম্যান, সিনেটর প্রায়ই ছুটে আসছেন বাংলাদেশীদের অনুষ্ঠানে।   একসময় নিয়ইয়র্কস্থ জাতিসংঘ স্থায়ী অফিসের স্বদেশী এক কর্তাকে নিয়ে আমরা প্রায়ই হাসাহাসি করতাম। কমিউনিটির জন্মদিন অনুষ্ঠান,লেডিস টেইলারের উদ্বোধন কিংবা খতনা দেয়ার অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন। কমিউনিটিকে ভালোবেসেই, গুরুত্ব দিয়েই তিনি এ কাজ করে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।   এখন দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। একসময় আমেরিকার কংগ্রেসম্যান, সিনেটরদের দেখা পাওয়ার জন্য ব্যাপক কাঠখড় পোড়াতে হতো। নিউইয়র্কের মতো সিটির সাবেক মেয়র বিল ডি ব্লাজিওকে পর্যন্ত বাংলাদেশীদের কোন অনুষ্ঠানে তেমন দেখা যায়নি। সময় দ্রুতই পাল্টাচ্ছে। এখন ইফতার পার্টি থেকে শুরু ডজন ডজন অনুষ্ঠানে সিনেটর, কংগ্রেসম্যান এবং মেয়রকে পাওয়া যাচ্ছে নিয়মিত। মসজিদ  উদ্ভোদন , কিরাত প্রতিযোগিতা এসব অনুষ্ঠানে তাদের ব্যাপক উপস্থিতি। বগলদাবা করে সাইটেশন আর পদক নিয়ে উপস্থিত হচ্ছেন এসব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বাংলাদেশীদের অনুষ্ঠানে।    এ অর্জন বাংলাদেশীদের সম্মিলিত অর্জন। জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠার কারণেই এমনটি হচ্ছে। কিছুদিন পরপর নিউইয়র্ক সিটির বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশ স্ট্রিট, লিটল বাংলাদেশ- এসব নামকরণ হচ্ছে। এসব নামকরণ অনুষ্ঠানে সিনেটর, কংগ্রেসম্যান, মেয়র থেকে শুরু করে নানা পদের লোকজন উপস্থিত থাকছেন। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি, বাহবা দিচ্ছি। সাইনবোর্ড ঝুলানোর জন্য কার কৃতিত্ব, এ নিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে ঝগড়াও করছি। অন্য কেউ না বললেও, নিজেই নিজের কৃতিত্বের দাবী করছি। নিজের নামে একটা সাইটেশন বা পদক নিয়ে ফেসবুকে ছবি দিচ্ছি।   সবই ঠিক আছে। নির্দোষ বিনোদন। এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক আমাদের বেলায়। যদিও পাশাপাশি এমন কিছু কাজ হচ্ছে, যা আমাদের লজ্জ্বিত করছে। এমন সব কাজ হচ্ছে , যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি না। এমন কিছু কাজ হচ্ছে, যা আমাদের মাথা হেঁট করে দিচ্ছে। বহুজাতিক সমাজে আমাদের সমস্যার কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে এসব কাজ।   উৎসব আর অনুষ্ঠানপ্রিয় আমাদের লোকজন। দূর প্রবাসে উৎসব আনন্দ নিয়ে একটু বেশীই আবেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। এ আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে আমাদের উৎসব আনন্দের প্রতিটি অনুষ্ঠানমালায়। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখ, ঈদের আগের চাঁদ রাতের মতো অনুষ্ঠানে।   গত কয়েক বছর থেকে ঈদের আগের রাতটি নিউইয়র্কের বিশেষ বিশেষ এলাকায় বাংলাদেশীদের হয়ে উঠে। এবারেও এমন হয়েছে। ২০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাত। পরদিন ঈদ। রাতটিতে নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটস থেকে শুরু করে ব্রুকলিন, জামাইকা এবং ব্রংকসের বিভিন্ন সড়কপথে ছিলো স্বদেশী নারী-পুরুষের উচ্ছ্বল উপস্থিতি। স্কুল-কলেজগামী তরুণীরা টেবিল আর টোল নিয়ে রাস্তার ধারে বসে পড়েন আগতদের মেহেদী-রাঙাতে। হাজার হাজার তরুণ তরুণী, যারা গভীর রাত পর্যন্ত হাতে মেহেদীর সাজে সজ্জিত হয়েছেন।   সব বয়সের লোকজনই যোগ দেন বাঁধভাঙ্গা এ জনজোয়ারের উৎসবে। একাধিক সড়ক ও ফুটপাথ বন্ধ করে দিয়ে চলছে উচ্চ লয়ের সংগীত। এরমধ্যে মারামারিও হয়েছে। ভাইরাল হয়ে উঠা ভিডিওতে দেখা গেছে জ্যাকসন হাইটসে চাঁদ রাতে মারামারি করছেন স্বদেশী নারী পুরুষরা। কেউ একজন টিকটকে দ্রুতই এ মারামারি শেয়ার করেন। হাজার হাজার শেয়ার হতে থাকে। একজন নারী পাল্টা তেড়ে আসছেন একজন পুরুষের দিকে। বীর পুরুষটিও সঙ্গী সাথীকে নিয়ে হামলা করছেন মারমুখী নারীকে। ভালো কাজের প্রচারে আমরা অলস হলেও এমন কাজের প্রচারেও আমাদের জুড়ি নেই !   বাংলাদেশীদের গড়ে উঠা চিরায়ত ভাবমূর্তির সাথে এমন পরিচয় যায় না। জ্যাকসন হাইটস, জামাইকা, ব্রঙ্গকস বা ব্রুকলিনের ওই বিশেষ এলাকায় শুধু বাংলাদেশীদের বসবাসই নয়। ত্রিশটিরও বেশি এথনিক কমিউনিটির বসবাস। এদের ভাষা ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন, বিশ্বাস ও চর্চা ভিন্ন । এ ভিন্নতার কারণেই অনন্য এ নিউইয়র্ক সিটি।   অন্যদের বিরক্ত করে, উত্যক্ত করে কোন অনুষ্ঠান আমরা করতে পারি না।   যে জনউচ্ছ্বলতার উপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের আগেই পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি নেয়া উচিত। যান চলাচলের সড়কে ডাবল পার্কিং করে, সড়কপথ বন্ধ করে রাতভর এমন উৎসবে মত্ত হওয়ার কোন অনুমোদন ছিলো না সিটি থেকে। মধ্যরাত পেরিয়ে গেলেও হাজার হাজার নিয়ন্ত্রণহীন লোকজনের অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু নগর পুলিশকে অসহায় দেখা গেছে। পুলিশকে বারবার সড়কপথ ফাঁকা করা এবং লাউড মিউজিক বন্ধ করার অনুরোধ করতে দেখা গেছে। হাজার হাজার মানুষের এমন উচ্ছ্বাসকে দমানোর কোন উদ্যোগ পুলিশ নেয়নি। এটি একটি সহনশীল সিটি হওয়ার কারণেই।   আমাদের চাঁদ রাত কিন্তু অন্যদের জন্য এটি একটি স্বাভাবিক রাত। লোকজন কাজে যাবে। তাঁরা গণউপদ্রব ছাড়াই নিদ্রায় যাবে, এটাই স্বাভাবিক। পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে কাজে যাবে, নির্দিষ্ট স্থানে পার্কিং করবে- এসব নাগরিক স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হলে লোকজন চরম বিরক্ত হয়ে থাকে। এমন বিরক্তি থেকে আমেরিকায় বহু ঘটনা ঘটেছে। বহু বিদ্বেষের ঘটনা, বহু হামলা ও গুলাগুলির ঘটনা ঘটেছে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন নাগরিক আচরণের কারনে।   এমনিতেই আমরা হৈ হোল্লোড়, চিৎকার চেঁচামেচি বেশি করে থাকি। ম্যানহাটনের ইউনিয়ন স্কয়ারে পাঁচ হাজার মানুষের সমাগম হলেও পাশের ব্লক থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। উৎসব আনন্দে যে নাগরিক শৃঙ্খলা দরকার আমাদের তা নেই। দশ জনের সমাবেশেই আমরা প্রথম ধাক্কাধাক্কি শুরু করি, কে মঞ্চে জায়গা করে নেবো তা নিয়ে। মঞ্চ দখলের মারামারি থেকে, যত্রতত্র আবর্জনা ফেলার মতো নাগরিক অপছন্দের কাজে আমাদের জুড়ি নেই।   নামাজ পড়ার জন্য সড়কপথে ডাবল পার্ক করা, অন্যের ড্রাইভওয়ে বন্ধ করে যাওয়া এসবের কারণে বহু এলাকায় লোকজনকে ক্ষুব্ধ হতে দেখা গেছে। এ নিয়ে খুনখারাপি পর্যন্ত হয়েছে আমেরিকায়। অন্য জাতিগোস্টি ও অন্যের ধর্মের লোকজনতো আপনার আমার আনন্দ, উৎসবের কথা জানে না। এ জানার দায়ও তাদের নেই। তাঁরা গণবিরক্তি আর গণউৎপাতকেই দেখে। দেখেও সহ্য ও সহনশীলতা দেখানোর ঘটনাই আমেরিকায় আমরা বেশি দেখি।   সবে সময় সর্বত্র 'সমান নাহি যায়'। আমরা যদি এসব ব্যাপারে এখনই সতর্ক না হই বিপদে পড়বো। ভাবমূর্তিই শুধু নষ্ট হবে এমন নয়। বিদ্বেষ বিরক্তিতে উত্যক্ত হয়ে দুর্ঘটনারও আশাংকা করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে প্রতিটি স্বদেশী বহুল এলাকায় কমিউনিটি নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যা করি, সম্মিলিতভাবে শৃঙ্খলার সাথে করতে হবে। যে শৃঙ্খলার উৎসবে অন্যরা বিরক্ত হবে না, অন্যরা উত্যক্ত হবে না। আগামী সব অনুষ্ঠান নিয়েই এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করাই কমিউনিটির জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কাজ।