ইসলামে পরোপকার
সুন্দর এ বসুন্ধরায় মানুষের জীবন কতই না বিচিত্র। সমাজ-সভ্যতা, জাতি-গোষ্ঠি, সাদা-কালো মূর্খ জ্ঞানী ইত্যাদি প্রকার প্রকারণে মানুষের মন মানসিকতা ও আচার-আচরণ আরও বৈচিত্র্যের। এ বৈচিত্র্যের নতুন সমন্বয় ঘটে বিশ্বাস নামক এক শক্তি। এ বিশ্বাস ও শক্তি মানুষের মাঝে অনাগত দিনের আশার আলো সঞ্চয় করে এবং বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়।
পৃথিবীর বুকে মানুষের সংখ্যা দিন-দিন যতই বাড়ছে মানুষে- মানুষে বিভেদ ও ভিন্নত রোগ-ব্যাধি দারিদ্র বঞ্চনাসহ নানা সমস্যা ততই সম্প্রসারিত হচ্ছে। এসব ভিন্নতর প্রকার ও প্রকরণের সমস্যার অবসানে প্রয়োজন আমাদের চারিত্রিক ও নৈতিক মূল্যবোধ। সব মানুষ এক হয়ে আর্তমানবতার সেবায় একই সূত্রে গ্র্থিত হোক এটা আজকের সমাজ জীবনে মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য একথা একেবারেই ভুলে গেছি। আজ প্রতিনিয়ত মানুষে মানুষে ঘাত-প্রতিঘাত, হিংসা অহংকার, রাজনৈতিক কলহ, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি হিংসাত্মক ঘটনা সমাজে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে।
এ কারণে দেশবাসী আজ শংকিত বিপন্ন মানবতা, বঞ্চিত অধিকার, লাঞ্চিত বিবেক সমাজে রুটিনে পরিণত হয়েছে। আসলে সব সৃষ্টিই আল্লাহপাকের, সৃষ্টির ও বিশাল পরিবেশ আল্লাহর রহমতের সেতুবন্ধন এবং পরিবারস্বরূপ। আল্লাহ একটি অন্যটির প্রয়োজনেই সৃষ্টি করেছেন। জগতে সকল সৃষ্টির মাঝে শ্রেষ্ঠ আশরাফুল মাখলুকাত। সৃষ্টিকুলের সেরা হিসাবে অন্যান্য সৃষ্টির প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক। মানব জাতির দুটি কর্তব্য একটি আল্লাহর ইবাদত অন্যটি সৃষ্টির সেবা। এ সেবাও একটি ইবাদত তাই বলা হয় মানুষকে ভালোবাসলে আল্লাহর ভালবাসা পাওয়া যায়।
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ ভাবে বসবাস করাই মানুষের অন্যতম স্বভাব। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত খাদ্য সংস্থান, গৃহ নির্মাণ রোগের প্রতিকার, বিদ্যার্জন থেকে শুরু সকল ক্ষেত্রে একে অপরের সাহায্য নিতে হয় । এজন্যই মানুষ মানুষের প্রয়োজনে নিবেদিত প্রাণ।
দুঃখ-কষ্ঠ, বালা-মসিবত, রোগ- শোক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওৎপ্রাতভাবে জড়িত। এ ধরণের দুর্যোগ আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে, এগুলো থেকে পৃথিবীর কোন মানব রেহাই পায় না। এগুলো মহান আল্লাহ পাকের পরীক্ষা। দীনের কাজে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে পারলেই এসব পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হওয়া যায়। জীবনটা ফুলশয্যা নয়, জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে সুখের স্বর্গ রচনা করতে হয়, বহু বাধা বিঘ্ন দুঃখ কষ্ট সহ্য করে সিদ্ধি লাভ করতে হয়। তাই জীবন পথের সকল বাধা বিপত্তি ও দুঃখ দুর্দশা বরণ করে ধৈর্য্যরে সাথে অগ্রসর হতে হয়। কেননা দুঃখের ভিতর দিয়ে সুখের আস্বাদ লাভ করা যায়।
দুনিয়ার আদি পুরুষ হযরত আদম (আঃ) এবং আদি নারী বিবি হাওয়া (আঃ) এ দুইজন থেকেই আজকের পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের জন্ম। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে গোটা মানবজাতি আদমেরই সন্তান, তাই মানব জাতিকে বনি আদম বলে আখ্যায়িত করা হয়। আর এ জাতির ভাব ভাতৃত্ব জাগিয়ে তোলার মাঝেই প্রকৃত মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধিত হয়।
সেবা একটি মানবীয় গুণবালীর অন্যতম দৃষ্টান্ত, আর্তপীড়িতের সেবায় এগিয়ে আসা আমাদের সকল স্তরের মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাই “যেখানে দুর্যোগ সেখানে সেবা” নিশ্চিত করতে হবে। বিগত বছরগুলোর মতই বাংলাদেশের কোন কোনও এলাকা বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম এলাকায় মানুষ চলতি বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েছে। বন্যা, কাল বৈশাখীর মহামারী দেশের মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে।
এছাড়া শহরাঞ্চলের ভাসমান মানুষসহ বিভিন্ন উপজেলার বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, সাগর ও নদীর তীর ভাঙ্গছে। দরিদ্র অসহায় জনগোষ্ঠির মাথাগোজার স্থান নেই, নেই দুবেলা পেট ভরে খাবার। ঘরে অসুস্থ রোগী বৃদ্ধ মাতাপিতা আর ব্যয় বহুল ঔষধ পত্র কেনার যোগান নেই। নেই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার সামর্থ। এভাবেই অসহায় পরিবারগুলোকে জিম্মি করে রেখেছে নানা দুর্যোগ, বন্যা ইত্যাদি। আমরা কি তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি না?
ইসলাম পরোপকারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, তোমার প্রতি আল্লাহ যেমন দয়া করেছেন তেমনি তুমিও মানুষের প্রতি তথা সকল জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শন কর, আল-কোরআন। এ থেকে জানা যায়, আর্তপীড়িত অসহায় গরীব জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী সাহায্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা কর্তব্য। পৃথীবীর সকল মুসলমান-মুসলমানের ভাই। যে ব্যক্তি নিজের ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে রত থাকবেন আল্লহপাক তার প্রয়োজন পূরণে রত থাকেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলামানকে কোন বিপদ থেকে উদ্ধার করবে আল্লাহপাক তাকে কেয়ামতের দিন বিপদ সমূহের মধ্যে কোন একটি বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।
(বুখারী ও মুসলিম) মহানবী (স.) বলেছেন, যখন কোন ব্যক্তি সদকা করে তা একটি খেজুরের সমানই হোক না কেন, আল্লাহপাক সে সদকার মালকে প্রতিপালন করে বর্ধিত করতে থাকেন যদি সে মাল হালালপথে উপার্জন করে থাকে। ঐ সদকা শেষ পর্যন্ত একটি পাহাড় সমান হয়ে যায়। তাই বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ (স.) আরও বলেন, যে ব্যক্তি ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করে আল্লাহপাক তাকে বেহেস্তের ফল ভক্ষণ করাবেন, যে ব্যক্তি তৃষ্ণার্থকে পানি পান করায় আল্লাহপাক তাকে জান্নাতে শরবত পান করাবেন, যে ব্যক্তি দরিদ্রকে বস্ত্র দান করে আল্লাহপাক তাকে জান্নাতির পোষাক পরিধান করাবেন।
আজ আমাদের দেশে দারিদ্রের কষাঘাতে অনেকের জীবন ওষ্ঠাগত, জীবন সংগ্রামে তারা বিপর্যস্ত সমাজে তারা নানাভাবে বিপদ ও ক্ষতিগ্রস্থ। এসব ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের হক রয়েছে আমাদের তথা মুসলমানদের ধন-সম্পদে। ইসলাম গরীব অসহায়, দুঃস্থ মিসকিন বিপদগ্রস্থ মানুষের সাহায্যের জন্য বিভিন্নভাবে তাগিদ দিয়েছে। এটা আমাদের সমাজ জীবনে নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। অথচ এ দায়িত্ব পালনে আমরা কতটুকু সচেতন? আজ মানুষ মানুষের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সমাজ জীবনে নেমে এসেছে বিশৃংখলা, সৃষ্টি হচ্ছে অশান্তি। নিজের স্বার্থ উদ্ধারেই আমরা ব্যস্ত।
তাই সমাজে অন্যায় অনাচার জুলুম নিপীড়ন শোষণ সুবিধাবাদ ধোকা প্রতারণা সর্বদা বিরাজ করছে। সমাজে আজ উপকারী মানুষের বড়ই অভাব অথচ মহৎ ব্যক্তিরা যুগে যুগে নিজের আত্মস্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে পরের উপকারে সব কিছু উৎসর্গ করে গেছেন।
আমাদেরকেও তাই সমাজের সকল বৈষম্য দূর করে ধর্মীয় মূল্যবোধের সমন্বয়ে সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা ও আর্তমানবতার সেবায় অগ্রসর হতে হবে। এটাই হতে হবে আমাদের প্রত্যয়, আমাদের প্রত্যাশা।