প্রকৃতির অসাধারণ সৌন্দর্যে ভরা মেঘালয়
মেঘালয় পূর্বে আসামের অংশ ছিল, কিন্তু ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি খাসি, গারো এবং জৈন্তিয়া হিলস জেলাগুলো নিয়ে মেঘালয় নামে নতুন রাজ্য গড়ে ওঠে। মেঘালয় অর্থাৎ মেঘের আবাসস্থল। রাজ্যজুড়েই যেন মেঘের অপূর্ব খেলা। এই রাজ্যের উত্তর ও পূর্ব দিকে আসাম এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে বাংলাদেশ অবস্থিত। মেঘালয়ের রাজধানী শিলং। বৃটিশ আমলে শিলংকে "প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড" বলা হতো।মেঘালয় রাজ্যটি ভারতের সবচেয়ে আর্দ্র অঞ্চল, দক্ষিণ খাসি পাহাড়ের সবচেয়ে আর্দ্র অঞ্চলে বছরে গড়ে ১২,০০০ মিমি (৪৭০ ইঞ্চি) বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। রাজ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ বনভূমি। স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি এবং উদ্ভিদের জীববৈচিত্র্যের জন্য বনগুলি উল্লেখযোগ্য। এই মেঘালয় রাজ্যেই পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের স্থান চেরাপুঞ্জি (Cherrapunji) অবস্থিত, যা বাংলাদেশের তামাবিল সীমান্ত থেকে একেবারেই নিকটে। রাজধানী শিলং থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরের এই শহরের উচ্চতা ৪,২৬৭ ফুট। বাংলাদেশ থেকে মেঘালয়ের শিলং বা চেরাপুঞ্জি যাবার সহজ এবং সংক্ষিপ্ত পথ হচ্ছে তামাবিল সীমান্ত দিয়ে কিন্তু করিমগঞ্জ জেলার বদরপুরে নিকটআত্মীয়দের সাথে সাক্ষাৎ এবং আমাদের বাড়ি (কুলাউড়া) থেকে করিমগঞ্জের সুতারকান্দি সীমান্ত অত্যন্ত নিকটবর্তি হওয়ায় আমি মেঘালয় গিয়েছি করিমগঞ্জের বদরপুর শহর হয়ে। চাচাতো ভাই আজহার এর সঙ্গে ওদের নিজস্ব গাড়িতে বদরপুর থেকে রওনা হয়ে ছোটছোট পাহাড়ঢালুর নয়নাভিরাম চা বাগানগুলোর মধ্যদিয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মেঘালয় রাজ্যের বিশাল পাহাড়ি অঞ্চলে পৌঁছে গেলাম। পাহাড়ের গা’বেয়ে ভয়ংকর সব পাহাড়িবাঁক পেরিয়ে আমাদের গাড়ি যখন ছুটছিল, আমার অন্তরআত্মা তখন মুহুর্মুহু কাঁপছিল। গাড়ি থেকে নিচে তাকালেই গা শিউরে উঠছিল বারবার। পিচঢালা পথগুলো বেশ প্রশস্থ হলেও, চলতিপথে কখনো কখনো আমাদের সম্মুখের বৃহদাকারের মালবাহী ট্রাকগুলো উঁচুপথে উঠতে না পেরে মাঝেমাঝেই আটকে যাচ্ছিল যা ছিল অত্যন্ত বিপদজনক। কোন কারণে ব্রেক ফেইল করলেই গাড়িসহ আমাদের কয়েকহাজার ফুট নিচে চলে যেতে হতো। পথে পথে অসাধারণ নান্দনিকতা নিয়ে অরণ্য আচ্ছাদিত সবুজ পাহাড়ের গায়ে মেঘের নাচন দেখার সময়টুকুনে বারবার যেন ছেদ ফেলছিল পাহাড়ের গভীর খাদের ভীতিকর দৃশ্য। এই অপরূপ দৃশ্য উপভোগের পূর্নতার জন্য মাঝে মাঝেই গাড়ি থামিয়ে নেমেছি, হেঁটেছি কিছুটা পথ। এমনি এক সময় মনে হলো যেন পাহাড়ের গা মাড়িয়ে বড়সরো মেঘেদের দল এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে, আমাদের সামনে দিয়েই রাস্তা অতিক্রম করলো বেশ আড়ম্বর করেই। অবাক নয়নে দেখা দৃশ্যটি মুহুর্তেই যেন রেকর্ড হয়ে গেল মানসপটে। কিছুটা পথ পেরুতেই শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি এবং বজ্রপাত, পাহাড়ের গায়ে বজ্রের ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে অপূর্ব ব্যাঞ্জনা সৃস্টির উল্লাস আমাদের হতবিহ্বল করে তুললো। খানিক পরেই আবার রৌদ্রের লুকোচুরি। এভাবেই যেতে যেতে এক ঝপাৎ বৃষ্টি তো এক ফালি রোদ্দুর, আমাদের ভাবনায় তখন শিলং আর কতদুর ! বদরপুর থেকে সকাল ৯.০০ টায় রওনা হয়ে যখন শিলং পৌঁছলাম তখন বিকেল ৩.৩০ বেজে গেছে। চমৎকার সাজানো শহর। একেবারে রঙিন শহর মনে হলো। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে শহরজুড়ে মানুষের প্রচন্ড ভিড় লেগে আছে, পর্যটন শহর বলে কথা! বেশিরভাগ পর্যটকরা কেনাকাটায় ব্যাস্ত। নানা বর্ণের, নানা চেহারার, নানা ভাষার, নানা জাতির মানুষ। দু একটি হোটেল দেখেশুনে হোটেল রয়েল রেসিডেন্সীতে রাত্রিবাস নিশ্চিত হলে ব্যাগব্যাগেজ রেখে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তার দুধারের স্ট্রীটফুড দোকানগুলোর খাবারের ঘ্রাণে পেটের ভেতর যেন চনমন করে উঠলো। পর্যটকরা সব যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, লাইন ধরে গরম গরম সব খাবার সংগ্রহের ধুম লেগেছে, আমরাও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঝটপট সান্ধ্যকালীন নাস্তা শেষে বেরিয়ে পড়লাম রাতের শিলং দেখতে। ন’টা বাজার আগেই শহর নীরব হয়ে যেতে লাগলো দেখে আমরাও ঘুরাঘুরি ক্ষান্ত দিয়ে নৈশভোজের জন্য একটি রেষ্টুরেন্টে বসে পড়লাম। ওখানে সিলেট থেকে আসা একটি বড় ট্যুরিস্টদলও পেয়ে গেলাম। খেয়েদেয়ে হোটেল কক্ষে উঠেপড়ে ঘুম আয়োজনে যখন নীরব হলাম তখন রাত্রি প্রায় সাড়ে দশ বেজে গেছে। ভোরবেলা ঝমঝম বৃষ্টির সাথে বজ্রের শব্দে ঘুম ভাঙলো। এমন বৃষ্টিসকালে শুধু ঘুমুতেই ইচ্ছে করছিল কিন্তু চেরাপুঞ্জী দেখে আবার শিলং ফিরে আসা এবং সন্ধ্যার মধ্যে আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে পৌঁছতে হবে তাই আলসেমি ছেড়ে উঠে পড়লাম। শিলং শহর ঘুরে ঘুরে সফরের ষষ্ঠ দিনের যাত্রা শুরু হলো। বৃষ্টির মধ্যে শহর ছেড়ে কিছুটা পাহড়ি পথ পেরুবার পর বিভিন্ন স্থানে রাস্তার উভয় পার্শ্বেই পাহাড় ধ্বস থেকে বিশাল আকৃতির সব পাথর বেড়িয়ে পড়ার দৃশ্যে বুকের মধ্যে দ্রুমদ্রারুম শুরু হয়ে গেল। যেকোন মুহুর্তে একটি শিলাখন্ড ছুটে এলেই সব শেষ হয়ে যাবে। এরমধ্যেই মানুষের জীবনের গতি থেমে নেই, দেখার বা জানার আগ্রহের কমতি নেই। দু পার্শ্বের উঁচু উঁচু পাহাড়ের মধ্যদিয়ে ট্যুরিস্টগাড়ি গুলো আঁকাবাঁকা পথ ছুটছে বেশ গতি নিয়েই। ক্রমশঃ শুধু উপরের দিকেই উঠছি। বিশাল আকৃতির সবুজ কিংবা নীল পাহাড়ের কোলঘেসে, মেঘ, রোদ্দুর আর বৃষ্টির লুটোপুটি খেলার অপরূপ দৃশমান বাস্তবতায় শুধু মনে হচ্ছিল, মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে না এলে প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য অদেখাই থেকে যেতো! পথে পথে বেশ দুরত্বে হলেও সুমুদ্রপৃষ্ঠের হাজার হাজার ফুট উপরের শহরগুলো মানুষের অদম্যতার কথাই জানান দিচ্ছিলো। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বাহারী রঙিন পাকাদালান কিংবা স্কুল ভবন গুলো দেখে ভাবছিলাম, শহরগুলো গড়ে ওঠতে কত বছরই না লেগেছে! আঁকাবাঁকা পাহাড়িপথে ছুটতে ছুটতে অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত চেরাপুঞ্জীর ‘সেভেন সিস্টার’ জলপ্রপাত দেখবার স্থানটিতে। ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে শতশত পর্যটক অপেক্ষা করছে, মেঘ সরে গেলে কখন দেখাযাবে ‘সাতবোন ঝর্নার’ অপরূপ দৃশ্য। আমাদের ভাগ্যসুপ্রসন্নই বলতে হবে, বেশিক্ষন অপেক্ষাকরতে হলোনা, হঠাৎ-ই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই উঁকি দেওয়া রোদ্দুরের খেলা, সেইসাথে মেঘের পর্দা সরেগেলে আমরা প্রাণভরে উপভোগ করলাম ঝর্ণাকুমারীদের নগ্ন শরীরের নন্দন নৃত্য! সবুজ অরণ্য আচ্ছাদিত পাহাড়ের চুড়ো থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে পাদদেশে নেমে আসা পাশাপাশি সাতটি জলপ্রপাতের নয়নাভিরাম দৃশ্য। অন্যান্য পর্যটকদের মতো আমরাও ছবি এবং ভিডিও ধারণের চেষ্টা করলাম কিন্তু এমন চোখেদেখা দৃশ্যের পরিস্ফুটন, অন্যকোন মাধ্যমেই প্রকাশকরা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ভরপুর পৃথিবীর সেরা জলপ্রপাত নায়াগ্রাও আমি দেখেছি কিন্তু চেরাপুঞ্জির এই সৌন্দর্যতা ভিন্নরকমের, সম্পূর্ন আলাদা। মিনিট দশেকের মধ্যেই সাতঝর্ণাকুমারীর নন্দন নৃত্যানুষ্ঠানের প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে গেলো মেঘের আড়ম্বতায়। মেঘের আলয় বলে কথা! তৃপ্তি এবং অতৃপ্তি মেশানো ভাললাগা নিয়ে আমারা ‘সেভেন সিস্টার’ পয়েন্ট থেকে রওনা হলাম ‘মাওয়াসমাই গুহায়’ যাওয়ার পথে। অল্পসময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম গুহা চত্বরে। ট্যুরিস্টদের ভীড় দেখেই বোঝাগেল গুহাভ্রমনের জনপ্রিয়তা। বিশেষকরে শিশু, কিশোর,তরুণদের হৈ, হুল্লোর আর উচ্ছ্বাসে মেতে আছে পুরো চত্বর। ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর অন্যতম আকর্ষণ হস্তশিল্পের নানা সম্ভারে সাজানো দোকানে ট্যুরিস্টদের ভিড় এলাকাকে আরো জমজমাট করে তুলেছে। মাওয়াসমাই গুহার প্রবেশদ্বার চেরাপুঞ্জি থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই চুনাপাথরের গুহা টি মেঘালয়ের অত্যন্ত আকর্ষনীয় গুহা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে, যা দর্শকদের গভীর আতঙ্ক নিয়ে প্রাকৃতিক গঠন উপভোগ করতে সক্ষম করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে যোগ্যতায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।
মাওয়াসমাই গুহা প্রায় ১৫০ মিটার লম্বা। এ গুহার প্রবেশমুখটা বেশ প্রশস্ত হলেও ভেতরে প্রবেশের পর মাঝে মাঝেই মনে হবে উল্টো ফিরে যাব কিনা । কিছু কিছু জায়গায় এত সরু যে প্রায় শুয়ে পড়ার মত করে কাত হয়ে সামনে এগুতে হয় । গুহার প্রবেশপথ উলম্ব এবং অত্যন্ত সংকীর্ণ। মেঘালয়ের অন্যতম আকর্ষণ মাওয়াসমাই গুহা তার বিশাল কক্ষগুলির জন্য বিখ্যাত যেগুলি অন্যান্য গুহার সাথে সংযুক্ত। ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে আমরা টিকেটকেটে গুহায় প্রবেশ করতেই আচমকা একটা ভৌতিক পরিবেশে যেন নিমজ্জিত হলাম। এও এক প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়! গুহা পরিদর্শন শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে গেল দেখে ফেরার জন্য আমার তাড়া শুরু হলো।
ভ্রমনসঙ্গী কাজিন আজহার এবং ভাতিজা ফারসাদ, অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটগুলো দেখানোর প্রচন্ড আগ্রহ প্রকাশ করলেও ফেরার পথে পাহাড়ের বিপদজনক বাঁকগুলো যেন সূর্যাস্তের পূর্বেই অতিক্রম করতে পারি সেই তাড়নায় আমি অস্থিরই হয়ে পড়েছিলাম। এবারে মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি থেকে আসাম রাজ্যের রাজধানী গুয়াহাটির উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরুহলো।বৃষ্টিভেজা রৌদ্রোজ্বল বিকেলে সবুজ পাহাড়ের গায়ে সাদামেঘের আড্ডাবাজির দৃশ্যের কাছে ভয়ঙ্কর খাড়া পাহাড়ি বাঁকের ভীতিকর বোধ কখন যেন পরাস্ত হয়ে গেল। একসময় গোধূলীর রক্তিম আভায় দৃশ্যপটের মাত্রা বদলে দিতে দিতেই ক্রমশঃ অন্ধকার নেমে আসলো পাহাড়ের গায়ে। আমরা ততক্ষনে আসাম রাজ্যের রাজধানী গুয়াহাটির খানিকটাই কাছাকাছি।