https://www.bartomansylhet.com/

3825

sports

প্রকাশিত

০৮ এপ্রিল ২০২৩ ০৭:৫৭

আপডেট

৩০ নভেম্বর -০০০১ ০০:০০

শহীদ অধ্যাপক ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদ: ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা

অধ্যাপক ডাঃ জিয়াউদ্দিন আহমেদ ( ফিলাডেলফিয়া ), শহীদ অধ্যাপক ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদের সন্তান।৯ এপ্রিল ১৯৭১ সাল।  সিলেট শহরে চলছে প্রচন্ড যুদ্ধ।  জয়দেবপুর থেকে আসা বিদ্রোহী দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের  ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে একটি ছোট বাঙালি কোম্পানী  অতর্কিতে হামলা চালায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা দিশাহারা হয়ে ৪ এপ্রিল এয়ারপোর্টের পাশে তাদের সালুটিকর ঘাঁটিতে পালিয়ে গিয়েছিল। কিছুদিনের জন্য মুক্ত সিলেটের কারাগার ভেঙে রাজনৈতিক ও অন্যান্য কয়েদীকে ছাড়ানো হল। সবাই তখন কারফিউ ভাঙার কারণে সিলেট ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে লাগলেন। প্রায় জন্য শূন্য সিলেটে তখন। পাকিস্তানী  সৈন্যদের গুলীতে আহত মানুষ দিয়ে সিলেট মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল পরিপূর্ন।  মেডিকেল কলেজের সার্জারীর প্রধান অধ্যাপক ডাঃ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালটিকে  কয়েকদিন থেকে সারাক্ষন আগলে ধরে আছেন।   সবাই যে যার মতো চলে গেছে। শুধু একজন তরুণ ডাক্তার, শ্যামল কান্তি লালা তার পরম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপককে রেখে কোথাও যাবেনা। এম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলী সারাক্ষণ আহত মানুষকে তুলে আনছেন। পুরুষ নার্স মাহমুদুর রহমান আর ওয়ার্ড বয় মুখলেসুর রহমান অপারেশন থিয়েটারে আর ওয়ার্ডে  অধ্যাপককে সহায়তা করতে ব্যস্ত।  ডাঃ শামসুদ্দিন বিপদ বুঝে আগেই অন্যান্য নার্সদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন।  কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা বাঙালী  সৈনিকরা পাকিস্তানি বিশাল বাহিনীর পাল্টা আক্রমনে পিছু হটতে বাধ্য হল। পাকিস্তানি সৈন্যরা ফের শহরে ঢুকেই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রবেশ করলো।  অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে আনলো অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমেদ ও তাঁর সহকর্মীদের। কিছু রোগী সহ তাঁদের সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভিতরেই গুলি করে তাদের হত্যা করলো। শুধু সেই ঘটনার সাক্ষী হয়ে মরার ভান করে বেচে গেলেন গুলিবিদ্ধ  মুখলেসুর রহমান।  হাসপাতালে আহত মানুষের সেবারত চিকিৎসক হত্যা শুধু বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাসে নয় বিশ্বের যুদ্ধের ইতিহাসে মানবতার বিরুদ্ধে একটি বড় জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করলো  হানাদার বাহিনী। শহীদ ডাঃ শামসুদ্দিন ও তার শহীদ সকল সাথীরা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাংলার মানুষের চেতনায়। ডাঃ শামসুদ্দিন তাঁর কর্তব্যবোধ, মানবতাবোধ , অসীম সাহসিকতা, পেশার উৎকর্ষতা ও সন্মান বৃদ্ধির জন্য আজীবন ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। হয়ে উঠলেন একটি কিংবদন্তী। সরকারি চাকরির জন্য যখন যেখানে বদলি হয়েছেন সেখানেই রেখেছেন তার অবিস্মরণীয় অবদান। তিনি তরুন বয়সে ঢাকায় থাকার সময় পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল এসেসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। প্রথম রিলিফ অরগাইজেশন “পাকিস্তান অ্যাম্বুলেন্স  কোরের “ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিসহ বহু জাতীয় পর্যায়ে ও জেলা পর্যায়ে সেবামূলক দায়িত্ব পালন করেছেন। যখন যেখানে গেছেন সেখানে মানুষ এবং সমাজ উন্নয়নকে সংগঠিত করেছেন। অসামান্য  অবদান রেখে গেছেন। ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনে তিনি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের সার্জারির অধ্যাপক ছিলেন ।  সেই সময় তার অসম সাহসী ও অনন্য ভূমিকা তখনকার সংগ্রামরত সমগ্র জাতিকে দিয়েছিল এক নতুন প্রাণশক্তি ।   পাকিস্তানের ইতিহাসে অনবরত সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র অধিকারের জন্য দেশব্যাপী ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন ছিল একটি উল্লেখ যোগ্য ঘটনা। প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের এক দশকের সামরিক শাসন হটাৎ করে বিরাট চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখি। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে শোষণ, রাজনৈতিক দলকে দমন এবং আগরতলা মিথ্যা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করায় পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনটি আরো জোরদার হল। মৌলানা ভাসানী সহ প্রায় সকল বাঙালি নেতৃবৃন্দ, ছাত্র , শ্রমিক, জনতা সবাই প্রাণপণে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লো।  আইয়ুব খান প্রমাদ গুনলেন আর জেনারেল ইয়াহিয়াকে সামরিক বাহিনী নিয়ে দমন নীতির নির্দেশ দিলেন।   রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলনের সময় একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান নিল।  সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের উত্তেজনা ও বিক্ষোভ ক্রমাগত বাড়তে লাগলো।  যেকোনো মুহূর্তে সামরিক বাহিনী ছাত্রদের উপর গুলি চালাবে সন্দেহ নেই,  এমন সময়ে এই বিপদ থেকে ছাত্রদের উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে এলেন এক জন তরুণ অধ্যাপক ডঃ শামসুজ জোহা।  ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলন সহ বাঙালির অধিকারের সকল আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রভাগে।  কিন্তু নিরস্ত্র ছাত্রদের আত্মহত্যার সামিল এই বিপদ থেকে উদ্ধার করাও আন্দোলনের একটি জরুরি পদক্ষেপ ছিল। ছাত্রদের পিছনে রেখে  এগিয়ে গেলেন রাইফেল তাক করা সৈন্যদের দিকে। বোঝাতে চাইলেন রক্ত ঝরানোর প্রয়োজন হবেনা।  ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবেই আন্দোলন করতে পারবে। কিন্তু হটাৎ করে সৈন্যরা গুলি ছুড়তে লাগলো।  হতভম্ব হয়ে ছত্রভঙ্গ হতে লাগলো সমাবেশ। গুলিতে আহত ডঃ জোহাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন চিকৎসকরা। অপারেশন রুমে তাড়াতাড়ি করে রক্ত স্রোত বন্ধ করা আর জীবন বাঁচানোর জন্য  চিকিৎসার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিলেন সার্জারীর অধ্যাপক ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদ।  অপারেশন করার সময়  অবাক হয়ে  দেখলেন শুধু  একটি গুলি নয় , সৈন্যরা খুব কাছ থেকে অনেক গুলি করেছে। এমনকি বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে জখম করেছে।  অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো গেলোনা ডঃ শামসুজজোহাকে। অত্যন্ত দুঃখিত আর ক্ষুব্ধ হয়ে রিপার্ট লিখলেন অধ্যাপক ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদ।  বিশদ ভাবে সমস্ত জখমের বর্ণনা দিলেন।  পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা এসে অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমেদকে জানালেন, তিনি যেন রিপোর্টে লিখেন একটি গুলি ভুলক্রমে লেগে গেছে। তিনি সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে তার দায়িত্ব যেন পালন করেন। অকুতোভয় ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদ স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, তিনি তার রিপোর্টে সত্য কথাই লিখবেন।  শুধু তাই নয় ডঃ শামসুজজোহার হত্যার প্রতিবাদে প্রথম সভা করেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে আর তার সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদ।  তিনি প্রেস রিলিজে পুরো ঘটনা প্রকাশ করেন। দেশের সব পত্রিকায় তার প্রেস রিলিজ  ছাপা হওয়ার সাথে সাথে কিছুটা স্থিমিত হওয়া গণআন্দোলন আবার দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়লো।     বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে কাছ থেকে বার বার গুলি করে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করার সংবাদ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন ও বিক্ষোভে ফেটে পড়লো।  সম্মিলিত এই আন্দোলনে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের পতন হল।  সামরিক শাসন জারি করে এবার ক্ষমতা নিলেন আরেক জল্লাদ জেনারেল ইয়াহিয়া খান। অধ্যাপক ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদ থেমে থাকলেন না।  কিছু দিন পরেই পাকিস্তান মেডিকেল এসোসিয়েশন রাজশাহী শাখার মিটিং। সমিতির সভাপতি ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদ তার তীব্র বক্তব্যে সামরিক বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। তিনি বললেন ছাত্রদের আন্দোলন যদি বিশৃঙ্খলা হয় তবে তাকে ঠেকাতে মানবিক ভাবে। আন্তর্জাতিক নীতি মেনে। বন্দুকের গুলি দিয়ে নয়। তিনি পরিষ্কার করে বললেন ডঃ জোহাকে অমানবিক ও নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাছাড়াও তাঁকে অনেক দেরি করে হাসপাতালে আনা হয়েছে যেটি গ্রহণ যোগ্য নয়।     সামরিক শাসনের এই ভয়াবহ সময়ে তার এই বক্তব্যে অনেকে এত ভীত হয়ে ছিলেন যে উপস্থিত আর কেউই কিছু বলতে সাহস পাননি । চলমান আন্দোলন তখন চরমে আর তাই আইয়ুব খানের দেয়া আগরতলা মামলার প্রধান আসামি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে ইয়াহিয়া খান মুক্তি দিতে বাধ্য হলেন এবং সাধারণ নিৰ্বাচন করার জন্য প্রতিস্তুতি দিলেন। সেই গণ আন্দোলনে তৎকালীন সিলেট এম সি কলেজের ছাত্র তার ছোট ছেলে এতটা জড়িয়ে পড়েছিল এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বাড়িতে মিছিল করে গিয়ে কালো পতাকা উত্তোলন করার জন্য তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো। পরিচিত গোয়েন্দা  বিভাগের কর্মকর্তা তাকে বন্ড সই করতে পরামর্শ দিলেন, যেন সে আর আন্দোলনে না আসে।  এতে করে নাম বাদ দেয়া হবে , আর তা না হলে তার বাবার সরকারি চাকরিও হারাতে হতে পারে। স্বল্পভাষী ডাঃ শামসুদ্দিন তাঁর  ছেলেকে ডেকে বললেন তুমি যে আন্দোললে গিয়েছো, সেটি কি তোমার শুধু তারুণ্যের উচ্ছাসে না তোমার রাজনৈতিক অঙ্গীকার ? তুমি যদি সত্যি এই আন্দোলনে বিশ্বাস করে যাও তাহলে পিছু হটবে না। আর যদি ভয় পাও তবে অন্যদের বিভ্রান্ত করার জন্য আর এডভেঞ্চার করার জন্য আন্দোলনে যাবেই না।  তোমার বাবা চাকরি চলে গেলেও চিন্তা নাই ,  প্রাইভেট প্র্যাক্টিস  করতে পারবে। তাঁর ছেলে অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো আর পরমুহূর্তে গ্রাপ্তানি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পলাতক হয়ে আন্দোলনে সক্ৰিয়  থাকলো। তারপর আয়ুব খানের পতনের সাথে ও এই আন্দোলনের চাপে জেনারেল ইয়াহিয়া প্রাথমিক পর্যায়ে সবার হুলিয়া বাতিল করেছিল।   অধ্যাপক ডাঃ শামসুদ্দীন আহমেদ তার কয়েক মাস পর সিলেট মেডিকেল কলেজে  সার্জারির প্রধান হয়ে বদলি হয়ে আসলেন। পাকিস্তানী ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকলো আর ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের শেষ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালী সংঘবদ্ধ হয়ে আওয়ামীলীগের নিরংকুশ জয় লাভ করার পরও সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করার পায়তারা করতে লাগলো।  ডাঃ শামসুদ্দিন সব ডাক্তার ও ছাত্রদের রক্তপাতের জন্য  হুশিয়ার থাকতে বললেন, এমনকি আলাদা ব্লাড ব্যাঙ্ক এবং ইমার্জেন্সি স্কয়াড নিজ হাতে গঠন করলেন। প্রায় সবাই তখন এই সাবধানবাণী বিশ্বাস করতে পারছিলোনা। ২৩ মার্চ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আরেক মুক্তি পাওয়া আসামী  ক্যাপ্টেন ( অব) মোত্তালেব মোটরসাইকেল চালিয়ে তাঁর বাসায় হাজির। জেলে অত্যাচারের ফলে আহত তিনি ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদের চিকিসৎসাধীন ছিলেন।  তাঁর হাতে ছিল একটি হত্যা তালিকা, যেটা সিলেটের খাদিম নগরের গারিসনের একজন বাঙালি সামরিক ইপিআর সদস্য পাকিস্তানিদের পরিকল্পনার সময় হাতে পেয়ে ছিলেন। সেই মৃত্যু তালিকার প্রথম দিকের নামের মধ্যে লিখা ছিল ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদের নাম।  ক্যাপ্টন মুত্তালিব এর পরেই ছুটলেন আওয়ামী  লীগের নেতা আর সংসদ সদস্য ফরিদ গাজীর বাড়িতে। তাঁকে আরও কয়েক জনের বাড়িতে যেতে হবে।  পিছনে ফিরে  দেখলেন ডাঃ শামসুদ্দিন অপলক তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন।     ২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা শুরু করলো গণ হত্যা। পথে ঘাটে নির্বিচারে হত্যা করতে লাগল বাঙালীদের। ডাঃ শামসুদ্দিন তাঁর ডাক্তার আর নার্সদের  দিয়ে গুলিবিদ্ধ মানুষের চিকিৎসায় ব্যস্ত থাকলেন। সেই সময়ে গুলিবিদ্ধ পাঞ্জাবী সেনাদের সাথে কর্মরত দু'জন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা, এক জন ক্যাপ্টেন মাহবুব আর আরেকজন লেফট্যানেন্ট ডাঃ সৈয়দ মাইনুদ্দিন আহমদকে  গুলি করে হাসপাতালে ফেলে যায়।      অপারেশন করেও মাহবুবকে তিনি বাঁচাতে পারলেন না। কিন্তু ডাঃ মাইনুদদীন আহমেদকে সারিয়ে তুলে গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। ডাঃ মাইনউদ্দিন  অনেক অনুরোধ করেন তিনি সিলেট শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। বলেছিলেন, স্যার আমি তাদের ডাক্তার ছিলাম আর তারাই আমাকে গুলি করেছে । আপনিতো কোনভাবেই নিরাপদ নন। কিন্তু ডাঃ শামসুদদীন মৃদু হেসে বলেছিলেন তোমরা তোমাদের কাজ কর, আমার হাসপাতালের আহতদের ছেড়ে যাবার উপায় নেই। কয়েকদিন মুক্ত থাকার পর ৯ এপ্রিল পাকিস্তানিরা সালুটিকর থেকে সংঘবদ্ধ  হয়ে আবার আক্রমণ করলে সিলেট হয়ে উঠে প্রচন্ড যুদ্ধ ক্ষেত্র।  ডাঃ শামসুদ্দিন তাঁর মা ও সন্তানদের আগেই রণকেলী গ্রামে এক বেয়াই বাড়ি ত পাঠিয়ে দিলেন।  তাঁর স্ত্রী সিলেট মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হোসনেয়ারা আহমেদকে থেকে যেতে বললেন, কারণ দুর্দিনে নার্স পাও না গেলে স্ত্রীর সহায়তা দরকার পড়বে। ছোটছেলে আগেই ২ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার জন্য চলে গেছে।  সবাই ডাঃ শামসুদ্দিনকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন, কিন্তু তিনি মৃদু হেসে বলতেন এখনই তো আমাদের হাসপাতাল আগলে ধরে থাকার কথা। এটি আমাদের পেশাগত অঙ্গীকার। তোমারা তোমাদের কাজ করতে চলে যাও।   ৯ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের আক্রমণের চাপে সিলেট ছাড়তে বাধ্য হয়। পাকিস্তানী সেনা বাহিনী সিলেটে প্রবেশ করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রবেশ করে এবং ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদ, তাঁর ইন্টার্ন শ্যামল কান্তি লালা সহ  ৯ জন বা আরো বেশি মানুষকে হাসপাতালের ভিতর গুলি করে হত্যা করে I তিন দিন পর কার্ফ্যু  ভাঙলে  স্বজনরা তাদের হাসপাতালের প্রাঙ্গনেই তাদের সমাহিত করেন।   শহীদ ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদ এবং তাঁর সহযোগীদের সমাধি আজ সিলেটের শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতি সৌধ। তাদের জন্য যদিও কোন জাতীয় সন্মান বা পদক কোনোদিন দেয়া হয়নি। তবে অগনিত মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসায় সিক্ত হয় তাদের স্মৃতিসৌধ। তাঁর জীবনের কথা,  মানবতার জয়গান,  পেশাগত দায়িত্ব আর দায়বদ্ধতা এবং আত্মত্যাগের কাহিনী হয়ত কোনো অনাগত চিকিৎসকদের একদিন অনুপ্রেরণা জাগাবে।  তবেই হবে তাঁর প্রতি সত্যিকারের সন্মান প্রদর্শণ। বাংলাদেশের সকল আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত  সব তথ্য আজও আমাদের অজানা।  তাই এই সব ঘটনার সূত্র ধরে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে আমাদের ঐতিহ্য এবং স্বাধীনতার ইতিহাস।