প্রচারনার স্বার্থে শিশুদেরকে ব্যাবহারে দরকার সাবধানতা
“আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই…”। নব্বই দশকের এই জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতটি সারা বাংলাদেশের মানুশের মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। কারন, সুরের মাধুর্যের পাশাপাশি এই গানের কথাগুলোর মধ্যে আছে আগামী পৃথিবীকে শিশুদের জন্যে বাসযোগ্য করার একটি সার্বজনীন আবেদন। তবে আরও একটি বক্তব্য এই গানের ভেতর লুকিয়ে আছে যেটা সরাসরি ধরা দেয় না। তা হচ্ছে, যারা শিশু নয় তাদের দায়িত্ব আগামী পৃথিবীকে শিশুদের জন্য বাসযোগ্য করার। সুতরাং, আমরা যেমন হাসিখুশি শিশুদের দেখতে চাই, তেমনি আমরা সেভাবেই কাজ করতে চাই যাতে আগামিতে প্রত্যেকটি শিশু হাসিখুশিভাবে বেড়ে উঠে একটি বাসযোগ্য পৃথিবীতে। এখানে শিশুদের কোন দায়িত্ব নেই। দায়িত্ব আমাদের, শিশুদের জন্য।
কথাগুলো বলা বর্তমান সময়ের কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেঃ ঘটনা ১) একটি সনামধন্য অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বেশ ভালো একটি কাজ করল। বাংলাদেশের অনগ্রসর নৃতাত্ত্বিক একটি গোষ্টির জন্যে তাদের নিজস্ব ভাষায় বই লিখল। সেটা প্রচারনার জন্যে একজন বাবা এবং শিশুর ছবি তারা সামাজিক যোগাযোগ মধ্যমে ছড়িয়ে দিল এমন পোশাক পরিহিত অবস্থায় যেগুলো পরে কোন নৃগোষ্ঠীর লোকজনও আজকাল পাবলিক পরিসরে আসে না। সেটা ঠিক না বেঠিক তা নিয়ে হয়ত যুক্তিতর্ক দুই পক্ষেরই থাকতে পারে, কিন্তু, যেই শিশুটি বাবার হাত থেকে বই কেরে নেয়ার চেষ্টা করেছে সেটা সে এত কিছু বুঝে করেনি। কারন নিজ ভাষার শিক্ষা-সংস্ক্রিতির গুরুত্ব অইটুকু শিশুর বোঝার কথা না। কিন্তু, প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপারটাকে এমনভাবে তুলে ধরল যেন শিশুটি সব বুঝে কাজটি করেছে। এখানে একটি শিশুকে ব্যাবহার করা হল প্রচারনার স্বার্থে।
ঘটনা ২) একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে এক প্রশাসনিক কর্মকর্তার সাথে ‘স্যার’ বলা নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি হল। অই শিক্ষক আন্দোলনে বসে পরলেন তার শিশুকে নিয়ে হাতে একটি প্ল্যাকার্ড ধরিয়ে দিয়ে। অই শিশুটির কিন্তু এটা বোঝার কথা না যে প্রশাসন এবং আমলাতন্ত্র কিভাবে কাজ করা উচিত বা উচিত না। সে নিজের উপলব্ধি থেকে কিছু করল না। কিন্তু, কেউ একজন তার উপর একধরণের তিক্ত উপলব্ধি চাপিয়ে দিল সে বড় হয়ে নিজের থেকে বুঝে উঠার আগে।
ঘটনা ৩) একজন সাংবাদিকের কোন এক দিনমজুরের সাক্ষাতকার প্রচার পেল সারা দেশ জুরে, দেশের চলমান খাদ্য মুল্যের সংকটকে ফুটিয়ে তুলে। এখানেও চলে এল একটি শিশুর ছবি, যদিও দ্রুতই সরিয়ে ফেলা হল। অই শিশুটি জানে না বাজার সংকট কি বা এর সাথে স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ গঠনের সম্পর্ক কি। শিশুটিকে ব্যাবহার করা হয়েছিল শুধুই প্রচারনার উদ্যেশ্যে।
এখন আসা যাক, প্রচারনায় শিশুদের ব্যাবহার করা কি একেবারেই নিশেধ। মোটেও তা না। কিন্তু, এর উদ্যেশ্য হতে হবে সবার আগে শিশুদের কল্যানে। যেমন, কোথাও দুরভিক্ষ হলে শিশুদের ছবি দেয়া হয়। কারন, শিশুদের সেখানে কল্যান চিন্তা আসে সবার আগে। দুর্ভিক্ষ পীরিত শিশুদের ছবি নেয়া হয় যাতে সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, অই শিশুদের পাশে এসে দাড়ায়। এখানে তাদের গোপনীয়তা নষ্ট হওয়ার চেয়ে তাদের বাঁচানোর তাগিদ অনেক বেশী গুরুত্ব পায়। কিন্তু, এখানে ছবিতে বা ভিডিওতে ফুটে উঠা শিশুরা হাজারো শিশুদের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠে, যারা সবাই পাবে হাসিখুশিভাবে বাঁচার জন্যে ক্ষুধা মুক্ত একটি পৃথিবী। আবার, আমরা প্রায় দেখি স্কুলে ভিবিন্ন সামাজিক কার্যক্রম, যেমন, আবর্জনা পরিষ্কার, বিভিন্ন দিবসের র্যালি এসব শিশুদেরকে দিয়ে করানো হয়। এর মানে এই নয় যে ওই শিশুরা আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছে বা র্যালির উদ্দ্যেশ্য সাধনের দায়িত্ব তারা নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে। এখানে শিশুদের ব্যাবহার করা হয় তাদেরকে ছোটবেলা থেকেই সচেতন করার জন্যে যাতে ভবিষ্যতে তারা উন্নত নাগরিক হয়ে উঠতে পারে।
এই যে শিশুদের প্রচারণায় ব্যবহারের পেছনে যেইসব মহৎ উদ্যেশ্য থাকে, সেখানে কখনও একটি শিশুর ব্যাক্তি জীবন ব্যাহত হয় না। কাজগুলো করা হয় শিশুদের কল্যানে, তাদের সুশিক্ষা দিতে, ভবিশ্যত নাগরিক হিসেবে সচেতন করার জন্যে, সুন্দর অভ্যাস তইরির জন্যে। কিন্তু, আমরা যেই তিনটি ঘটনা সাম্প্রতিক কালে দেখলাম সেগুলো এই চিন্তাগুলো মাথায় রেখে করা হয়েছে বলে মনে হয় না। সারা দেশে অসংখ্য সমস্যা। এখন সব সমস্যা যদি আমরা শিশুদের সামনে নিয়ে আসি তাহলে শিশুরা কিভাবে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বড় হবে? আর সমস্থ জঞ্জাল পরিষ্কারের দায়িত্ব আমাদের, শিশুদের না। তার মানে এই নয় যে শিশুদের কোন উপলব্ধি তইরি করতে দেয়া যাবে না। সেটা ধিরে ধিরে তারা এমনিতেই উপলব্ধি করবে বেড়ে উঠার সাথে সাথে। কিন্তু, আমরা যদি তারা বেড়ে উঠার আগেই তাদেরকে রাজ্যের চিন্তা কার্যক্রম ধরিয়ে দেই, যেটার দায়িত্ব আমাদের, তাহলে এটা তাদের স্বাভাবিক বেড়ে উঠাকে বাধাগ্রস্থ করবে। মানসিকভাবে তারা শুধু একটি অন্যায় পৃথিবীকে দেখবে বা সব কিছু তার নিজ দায়িত্ব ভেবে করা শুরু করবে, সব কিছু বুঝে উঠার আগেই।
আমি বলছি না ঘটনা তিনটির সাথে জরিত বড়রা খুব অন্যায় করে ফেলেছেন। তারা হয়ত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কাজগুলো করেছেন। কিন্তু, আমার মনে হয় শিশুদেরকে প্রচারনার স্বার্থে ব্যাবহারের ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশী সাবধান হওয়া উচিত। আমাদের বোঝা উচিত, এটা যেন কোন শিশুকে ব্যবহার করে এমন প্রচারনা না হয় যা তার কচি মনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না; তার ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা এবং শালীনতা যেন কোনভাবেই প্রভাবিত না হয়। অই জনপ্রিয় গানের অন্তর্নিহিত অর্থের মতই মনে রাখতে হবে ‘সাজানো বাগান’ তইরির দায়িত্ব আমাদের, শিশুদের না।