https://www.bartomansylhet.com/

3741

politics

প্রকাশিত

০২ এপ্রিল ২০২৩ ০৭:০৭

আপডেট

৩০ নভেম্বর -০০০১ ০০:০০

বৈষম্য হ্রাসে যাকাতের তাৎপর্য

একটি সুস্থ এবং আদর্শ সমাজ গঠনের প্রধান এবং পূর্ব শর্ত হল সেই সমাজে সমতা আনয়ন করা। অর্থাৎ কোন সমাজে বৈষম্য বিদ্যমান রেখে সেই সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। বৈষম্যমূলক সমাজে প্রতিনিয়ত চলে শোষণ এবং নিপীড়ন। বৈষম্য বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে এবং সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রকট হচ্ছে আর্থিক বৈষম্য। আর্থিক বৈষম্য একটি সমাজের মেরুদন্ডকে ভেঙ্গে দেয় এবং শ্রেণী বিভাজন প্রকট করে তোলে। সমাজের বৈষম্য দূর করার জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উত্তম ব্যবস্থা হল যাকাত প্রদান করা। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যাকাত প্রদান করার অর্থ গরীবের প্রতি অনুকম্পা দেখানো নয়, যাকাত হল গরীবের হক যেটা কোরআনে বার বার বলা হয়েছে।

 

যাকাত ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি। যাকাত দেয়া কাদের বাধ্যতামূলক সেটার সুস্পষ্ট নির্দেশনা কোরআনে দেয়া আছে।  যাকাত প্রদানকে কোরআনে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে যাকাত শব্দটি বহুবার উচ্চারিত হয়েছে। যাকাত একটি আরবী শব্দ যার অর্থ পরিশুদ্ধকরণ, পবিত্রকরণ ইত্যাদি। যারা যাকাত পাবেন তাদের একটি তালিকা আল- কোরআনে উল্লেখিত আছে। তারা হলেন- ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায়-হেফাজত ও বন্টনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি, কোন অমুসলিম ( যদি চরম আর্থিক সংকটে থাকে), ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, মুসাফির ( যিনি ভ্রমণের সময়  চরম অর্থ সংকটে ভুগেন) এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা কাজ করেন। পবিত্র কোরআনের সুরা আত-তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতে যাকাত বণ্টনের এই খাতগুলি উল্লেখ করা হয়েছে। যাকাতকে ইসলামের প্রধান আর্থিক ইবাদত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।

 

ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি ধরা হয় যাকাতকে। যাকাতের মাধ্যমে সমাজে অর্থের সুষম বণ্টন ত্বরান্বিত হয়। ঈমানের পর সালাত ও যাকাতের কথা বার বার বলা হয়েছে। সুরা বাকারা : ১১০ এ যাকাত দেয়ার স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং এটিকে অতি উত্তম কাজ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা নূর : ৫৬ এ যাকাত প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ধনী ও গরীবের সেতুবন্ধন তৈরি করে এই যাকাত। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। সুরা নিসার ১৬২ নং আয়াতে বলা হয়েছে যারা ইসলামের বিধান অনুযায়ী যাকাত প্রদান করে তারা আল্লাহর কাছ থেকে মহা পুরস্কার পাবেন। যাকাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কোন সময়ের বাধ্যবাদকতা নেই। তবে রমজান মাসকেই যাকাত প্রদানের সর্বোত্তম মাস হিসাবে গন্য করা হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের দারিদ্র বিমোচনে যাকাত অনন্য ভূমিকা পালন করে।

 

যাকাত অর্থের অপচয়কে রোধ করে এবং ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতিকে নিশ্চিত করে। অনেকে মনে করতে পারেন যে যাকাত দিলে তার অর্থ কমে যাবে এবং সে দরিদ্র হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এটি একটি মহা ভুল ধারণা। যাকাত দেয়ার যে বিধান কোরআনে বর্ণিত আছে সেটা অনেক সহনশীল। একজন মানুষের আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রদান করতে হয়। যারা যাকাত পেয়ে থাকেন তারা আমাদেরই আত্মীয়, আমাদের আপনজন। সমাজে ভাতৃত্ববোধের একটি দারুণ সুযোগ সৃষ্টি করে এই যাকাত। যাকাতের বহুমুখী উপকারীতা রয়েছে। ১. যাকাত প্রদানকারী আল্লাহর ভালোবাসা ও রহমত লাভ করেন ২.  যাকাত মনকে পবিত্র করে ৩. যাকাত দিলে আয় রোজগার পরিশুদ্ধ হয় ৩. যাকাত বৈধ ও হালাল উপার্জনকে উৎসাহিত করে ৪.যাকাত সামাজিক বৈষম্য দূর করে সমতা আনে ৫. যাকাত ধনী ও গরীবের ব্যবধান কমিয়ে দারুণ মেলবন্ধন তৈরি করে ৬. যাকাত দায়িত্ববোধের সৃষ্টি করে ৭. যাকাত যেহেতু একটি হক তাই এটি গরীবের অধিকারকে নিশ্চিত করে ৮. সাম্যবাদী সমাজ গঠনে যাকাত অনন্য ভূমিকা রাখে ৯. যাকাত প্রদানকারী আল্লাহকে ভয় করে তাই সে অসৎ উপার্জনকে বর্জন করে ১০.যাকাত গরীব ও অসহায়ের মুখে হাসি ফোটায়।

 

একটি রাষ্ট্রের বা সমাজের সব মানুষের আয় রোজগার সমান হয় না। অবস্থা ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কেউ অধিক আয় করে থাকেন আর কেউ খুব সীমিত আয় করে থাকেন। কিন্তু সমাজে এমন কিছু মানুষ থাকে যারা আয় রোজগার করতে পারেন না। এসকল মানুষের জন্যই যাকাতের বিধান রয়েছে। বিশ্বায়ন এবং পুঁজিবাদের জাঁতাকলে পিষ্ট আজ  মানব সভ্যতা। পুঁজিবাদী সমাজে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। পুঁজিবাদীরা শোষক শ্রেণিতে পরিনত হয় আর বাকিরা শোষিত হতে থাকে। যাকাত পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার  পরিবর্তে সাম্যবাদী অর্থ ব্যবস্থা নিশ্চিত করে।  বাংলাদেশের অনেক বিত্তশালী আছে, তারা যদি নিয়মমত যাকাত প্রদান করে তবে আর্থিক বৈষম্য অনেকাংশে কমে যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে অনেকে টাকার পাহাড় গড়লেও গরীবের দিকে তাকানোর সময় তাদের নেই। আবার কেউ কেউ আছেন একটুখানি দান খয়রাত করে ঢোল পেটাতে থাকেন।

 

যাকাত যেহেতু একটি নির্দিষ্ট বিধান মেনে চলে তাই যাকাত প্রদান করলে বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষ একটু স্বস্তিতে থাকতে পারে। আমাদের দেশে অনেক সময় যাকাত প্রদান বিষয়টি রাজনীতির কবলে পড়ে যায়। যাকাত প্রদানের নামে ভোটব্যাংক সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা দেখা যায় যা মোটেও কাম্য নয়। অনেক ক্ষেত্রে যাকাতের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি যাকাত পান না। স্বচ্ছল ব্যক্তিরাও অনেক ক্ষেত্রে কৌশলে যাকাতের অর্থ আত্মসাৎ করে থাকে। কিন্তু যাকাতের জন্য কারা উপযুক্ত তা নির্দিষ্টভাবে বলা আছে। যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রেও শৃংঙ্খলা থাকতে হবে। যাকাত প্রদানের সময় প্রচন্ড ভিড়ে পদদলিত হয়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।  যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে নির্বাচনী ইমেজ অনেক সময়  বড় হয়ে দেখা দেয় যা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। যাকাত যতটা সম্ভব নীরবে দিতে হবে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে, মাইক বাজিয়ে যাকাত প্রদান ইসলাম অনুমোদন করে না। যাহোক যাকাত প্রদান ব্যক্তিগতভাবে হতে পারে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেও হতে পারে।

 

১৯৮২  সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক যাকাত ফান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। প্রাতিষ্ঠানিক যাকাত ফান্ডকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে যাকাত পাওয়ার জন্য কারা উপযুক্ত সেটার একটি সঠিক জরিপ হওয়া প্রয়োজন। সঠিক জরিপ থাকলে সংখ্যাটাও বের করা সম্ভব। এলোমেলো যাকাত প্রদানে সুফল শতভাগ আসে না। জেলা, উপজেলা, থানা ও ইউনিয়নভিত্তিক জরিপ করা যেতে পারে। এর ফলে যাকাতের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট সংখ্যাটি পাওয়া যাবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাতের ফান্ড বৃদ্ধি করা গেলে দুস্থ মানুষেরা আরো বেশি উপকৃত হবে। গত দুই বছরে করোনায় বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।

 

আর্থিকভাবে বহু মানুষ চাপে আছে। এতিম, অসহায়, পথশিশু, সহ গরীব মানুষেরা আগামী ঈদের আগে যাকাতের অর্থ হাতে পেলে তারাও সুন্দরভাবে ঈদ উৎসব করতে পারবে। বাংলাদেশের প্রতিটি স্বচ্ছল মানুষ যদি নিয়ম অনুযায়ী যাকাত প্রদান করে তাহলে দারিদ্র নিরসনের যে মহা চ্যালেঞ্জ সরকারের রয়েছে সেটা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। যাকাত প্রদান করে একদিকে যেমন ধর্মীয় অনুশাসন মান্য করা হয়, অন্যদিকে বৈসম্যহীন সমাজ গঠনের একজন অংশীদার হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। যাকাত হিসাবে নগদ সহায়তা করা যেতে পারে, আবার পোশাক পরিচ্ছদ দিয়েও সহায়তা করা যায়। যাকাতের সাথে একজন মুসলিম হিসাবে ফিতরাও আদায় করতে হয়।

 

যাকাত ও ফিতরা প্রদানে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আন্তরিকতা। হোটেল, রেস্তোরা আর পার্কে বসে ধনীদের যে অর্থের অপচয় হয় তার কিঞ্চিত অংশ গরীবেরা পেলে তাদের মুখে হাসি ফুটে। একা কখনো সুখী হওয়া যায় না। পাশের মানুষটিকে অভুক্ত রেখে নিজে ভোগ বিলাসে জীবন পার করার মধ্যে কোন আনন্দ নেই। জন স্টুয়ার্ট মিলের কথা ধরেই বলতে হয় ব্যক্তিগত সুখ তখনই পূর্ণতা পায় যখন তা সার্বিকে মিশে।