শামীমপুরের চর দখল
বড় বড় মুচ, চোখ দুটি বাঘের মত ,গায়ে একটা বড় লম্বা জামা হাতে অনেক বড় লম্বা লাঠি, মাথায় লম্বা লম্বা চুল, উচ্চতা প্রায় সাত ফিট, যেমন কালো তেমন ভূতের মত চেহারা,অনেক জোরে জোরে সামনের দিকে হেঁটে দাঁতের উপর দাঁত রেখে ককশ ভাষায় জোরে হুংকার, তজন, গজন ছেড়ে ছলে বাঙ্গালের লোকেরা বলল হুম মামুর বেটা তোমরা কারা কোথায় থেকে এসেছ শামীমপুরের চর দখল করতে। ছলে বাঙ্গালের সাথে ছিল বিরাট লাঠিয়াল বাহিনী তাদের কারো একহাতে রামদা আর এক হাতে সড়কি, কারো এক হাতে বড় লম্বা হাসি অন্য হাতে টেটা, কারো এক হাতে বড় লাঠি অন্য হাতে সুরকি, কারো হাতে তীর ও ধনুক, কারো হাতে ডেগার, কারো হাতে ফালা,আবার কারো হাতে চাইনিজ কুড়াল নিয়ে নদীর এই পারের লোকদের দাওয়া করতে লাগল। ভয়ে নদীর এই পারের লোকেরা দৌঁডে নৌকার কাছে এসে নৌকায় উঠে বাড়ির দিকে পাল তুলে, বৈটা টেনে রওনা দিল। ছলে বাঙ্গালের বিরাট লাঠিয়াল বাহিনী ছররা গুলি ছাড়তে লাগল। গুলি এসে নৌকার পালে আবার কারো গায়ে লাগতে লাগল। এতে কেউ কেউ গুরুতর আহত হল।
নদীর এপারের লোকেরা নদীর কিনারে আসলে অনেক লোক দেখতে আসল । যাদের গায়ে ছররা গুলি লেগেছে তাদের হাঁসপাতালে ভর্তি করা হল। আরজ আলী মাতব্বরের ডাকে দশ গ্রামের মানুষ এক সাথে হয়ে মিটিং এ বসল। অনেকে বলল আমাদের বাপ দাদার চর এটা আমরা দখল করব তাতে বাঁচি আর মরি যা হয় হবে।তারা সবাই মিলে প্লান করল তারা বিশটা নৌকা ভরে একদিন যেয়ে শামীমপুরের চর দখল করবে।তারা ঢাল, তরোয়াল, সড়কি, ফালা, তীর ও ধনুক, চাপাতি, রামদা, লাঠি, ইটের সুরকি ও পিস্তল নিয়ে নৌকা ভর্তি করতে লাগল। তারা লুঙ্গি পড়ে কাঁচা মেরে মাথায় গামছা বেঁধে গায়ে একটা গেনজি পড়ে সৃষ্টিকতার নাম স্মরণ করে নৌকা গুলো একএে শামিমপুরের চরের দিকে রওনা হল।
তারা সবাই একএে নৌকা থেকে নেমে শামীম পুরের চরের দিকে আমাদের বাপ দাদার চর বলতে বলতে দাবিত হল।কিছু লোকের দায়িত্ব দেওয়া হল যদি ছলে বাঙ্গালের লোকেরা আক্রমন করে তাহলে তারা সব সরজ্ঞাম নিয়ে এগে যাবে।এত লোক দেখে ছলে বাঙ্গালের লোকেরা আর কাছে আসতে সাহস পাই নাই। তারা সবাই একএে হয়ে চর দখল করল। বড় একটা লগির সাথে লাল নিশান উড়া রাখল। চককে চক মটর কলই আর রাই বুনে চর দখল করল। তাদের কতদূর সীমানা সেখানে বড় বড় জিকার ডাল গেরে রাখল। সারা চরে পাট খড়ি গেরে রাখল। তারা একটু পর পর লাঠি গেরে রাখল। তারা জায়গায় জায়গায় বিননির ছোপ গেরে রাখল। তারা বন ও ছন দিয়ে একটা বাওর তুলল। ছলে বাঙ্গালের লোকদের কথাবার্তায় মনে হয়েছিল
তারা একাই শামীমপুর চরের মালিক আর অন্যদের কোন জমি এখানে নাই। শামীমপুরের চরের মালিক শুধু ছলে বাঙালিরা না। এ চরের মালিক চরের এ পারের ও চরের ঐ পারের লোকেরা । বিরাট একটা এলাকা নিয়ে শামিলপুরের চর। কিন্তু নদীতে ভেঁঙ্গে চরটা বিলীন হয়ে যায়। অনেক বছর পরে শামীমপুরের চরটা জেগে উঠে। চরে প্রচুর পলিমাটি পড়ে । বিশাল এলাকা ধরে একবারে চর জেগে উঠে।
এই চরের সীমানা নিয়ে হয় কত যে ঝগড়া। যারা জমির মালিক তারা দাবি করে এ চর তাদের আর যারা জমির মালিক নয় তারা ও দাবি করে এ চর তাদের। নদীতে নতুন চর উঠলে এ রকম সমস্যা অহরহ হয়। এখানে ক্ষমতার প্রাধান্য দেওয়া হয় বেশি। যাদের লাঠির জোর বেশি তারা ক্ষমতার বলে জমি দখল করে নেয়। নতুন চরে পিরদান আর মাতুব্বরে থাকে ভরা। নদীর ঐ পাড়ের লোকেরা দলবল নিয়ে চলে আসে জমি দখল করবার। যদি অন্য কোন দল না থাকে তারা বিরাট এলাকা ধরে বেরিকেড দেয়। তারা বড় মস্তুলের সাথে একটি লাল কাপড় দিয়ে বেঁধে মাটিতে গেরে রেখে আসে। তারা নতুন পলিমাটিতে ঝিকার ডাল গেরে ঠিকানা পরিমাপ করে। তারা বিস্তৃত এলাকা ধরে নিশান টানা আসে। সরিষা, রাই, খেসারি বুনে জমি দখল করে যায়। অন্য পক্ষ এসে তা উঠে ফেলে তারা আমিন নিয়ে জমি মেপে নতুন করে নিশানা দিয়ে যায় ।একবারে দলবল নিয়ে সবাই অসে। এখানে টানটান উওেজনা একটা ভাব থাকে।
এক দলের লোক এসে জমি মেপে বিননের ছপ, ঝিকার ডাল বা লাঠি গেরে রেখে যায়। আর এক দল এসে নতুন করে মেপে আবার লাঠি, গারে। এখানে ঝগড়া বা কাঝি লেগে থাকে । কেউ ফসল বুনে কেউ আবার ফসল ভেঁঙ্গে আবার বুনে। তৃতীয় পক্ষ এসে আবার জমি দখল করে। এক পক্ষ দিনে ফসল কাটলে আর এক পক্ষ এসে কাটে রাতে। হিংসাপরায়নবশত: কেউ আবার জমির কাঁচা ফসল কাটে। জমির মুল মালিকেরা খুব কমই পাড়ে জমি দখল করতে। শামীমপুরের চর নিয়ে কত যে মারামারি হয় দু পক্ষের মধ্যে । এখানে রক্তক্ষয়ী সংঘষ হয়। এ সংঘষে কেউ আবার মরে যায়।
নদীর পারের লোকদের জীবন অনেক কঠিন হয়। যদি নদীতে চর ভেঁঙ্গে যায় তাদের দু:খের সীমা থাকে না। নদীর পারের লোক হয়ে যায় ঘরবাড়ি জমি জমা সবকিছু হারা। তারা রাস্তার ধারে গিয়ে বাড়ি করে। তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। তারা কোথায় থেকে কোথায় যে চলে যায়। দু:খ হয় তাদের নিত্যদিনের সাথি। নদীতে আবার চর উঠলে ও সে চর দখল করা নিয়ে ঝগড়া বিপদ, মারামারি, খুন খারাপি ও কেজ কাবারি কত কিছু যে হয়। ফসল বুনে সে ফসল আর ঘরে তোলা যায় না। গায়ের জোরে লাঠির বলে ফসল কেটে নিয়ে যায়। ফলে প্রকৃত জমির মালিকেরা ফসল বা জমি কিছুই পায় না। এক পক্ষ জোর করে জমি দখল করে আর এক পক্ষ জোর করে ফসল কাটে।
তবে নদীর চরে ফসল অনেক ভাল হয়। এখানে সরিষা, রাই, মাস কলাই. ধান, সোলা, বাদাম, যব ,গম, চিনা, বুড়ি কাউন, মসনি, তিল, মটর কলই, কালি কলই সব রকমের ফসল ভাল হয়। এখানে সাভারে অথাৎ একএে জমি চাষ করা হয়। এখানে এক থেকে দু শত ভাগি হয়। সবাই একএে ফসল বুনে, ফসল কাটে এবং ফসল ভাগ করে নেয়। এখানে যারা মাতব্বর থাকে তারা আবার অতিরিক্ত একটা ভাগ পায়। মাতব্বরের কথা লোকেরা মেনে চলে এবং মত কে প্রাধান্য দেওয়া হয় বেশি।
এক সাথে ফসল বুনে বা তুলে নদীর পাড়ের লোকেরা অনেক মজা পায়। নৌকা ভরে ফসল আনার সময় লোকেরা মাঝে মাঝে আল্লাহর ধ্বনি দেয়। বলে আল্লাহ আল্লাহ রসুল বল, লাই লাহা এ। মাথায় করে নৌকা থেকে ফসল নেয়। ধান তারা গরু দিয়ে মলে ভাগ করে নেয়। ১০০ বা ২০০ ভাগ যত গুলো ভাগি আছে তত গুলো কাগজে নাম লেখে। কাগজ দেখে যার যে ভাগ পড়ে সে সে ভাগ নেয়। নদীর চরে একসাথে বহরে কাজ করে কৃষকেরা সেই মজা পায়। তারা মাথায় মাতাল, ছাতি বা গামছা দিয়ে রৌদ্রের মধ্যে কাজ করে। তারা বারাসিগান গায়। কত রকম শোলক যে চলে। কালু গাজির গান ধরে। ছায়ায় গামছা বিছে বসে বিড়ি টানে। কত রকম হাসি তামাশা যে করে।
নদীর চরে আবার অনেক সময় মাতুব্বরেরা আমিন নিয়ে এসে একসাথে বসে একটা ভাগ করে নেয়। তবে নদীর চরে লুটপাট একটা নিত্যনৈমিওিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। রাতে চুরি করে কেউ কেউ আবার ফসল কেটে নেয়। কেউ আবার গরু দিয়ে কাঁচা ফসল খাওয়া দেয়। এখন আর আগের মত তেমন চর আর জেগে উঠে না। নদী তার গতি হারিয়ে ফেলছে।
এজন্য বর্তমান যুগে নদীর চর নিয়ে তেমন ঝগডা লাগে না। শামীমপুরের চর বাস্তবে কোন চর নয়। আর ছলে বাঙ্গাল ও আরজ আলী মাতব্বর বাস্তবে কোন লোক নয়। উপমা হিসাবে সব কিছু তুলে ধরা হয়েছে। অনেক আগে এরকম ঘঠনা ঘটত তার আলোকে গল্পটা লেখা।