https://www.bartomansylhet.com/

3646

bangladesh

প্রকাশিত

২৫ মার্চ ২০২৩ ১২:৩৬

আপডেট

৩০ নভেম্বর -০০০১ ০০:০০

ক্রেডিট সমস্যা নতুন অভিবাসীদের আমেরিকার স্বপ্ন পূরণে বাধা

sabbir chowdhury Jibon ক্রেডিট সমস্যাটি শুধু অর্থনৈতিক নয়। পশ্চিমা দেশে নতুন আসা অভিবাসীরা আচমকাই এ সমস্যায় পড়েন। পূর্বধারণা ও সচেতনতা না থাকার কারণে তাঁদের হোঁচট খেতে হয়। দেনা-পাওনার ফাঁদে পড়ে অনেকেই ব্যক্তিগত ক্রেডিট সমস্যায় পড়েন। বাড়ি গাড়ি কেনা থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন লোকজন। ক্রেডিট সমস্যায় পড়া এসব লোকজন সমাধানের খোঁজার জন্য দ্বারস্ত হয়েও প্রতারণার মুখোমুখী হচ্ছেন হরহামেশা।

আইন, ব্যবস্থাপনা, ঋণ চুক্তি নিয়ে আমেরিকার সমাজে ক্রেডিট একটি গ্রুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এ নিয়ে এদেশে আসা নতুন অভিবাসীদের পরামর্শ দেয়ার যথেষ্ট সংগঠন নেই। বদরুল ইসলাম নামের এক প্রবাসী দুই দশক আগে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হয়ে আমেরিকায় আসেন। ১২ বছর ইয়েলো ট্যাক্সি চালিয়ে সঞ্চয় করে সিটির ম্যাডেলিয়ান কেনেনে নিজের সঞ্চয় ও ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে। ২০১২ সালের দিকে নিউইয়র্ক সিটিতে ট্যাক্সি ব্যবসায় ধস নামলে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধে পিছিয়ে পড়েন বদরুল ইসলাম। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি তাঁর কাছ থেকে ময়াডেলিয়ন নিয়ে যায়। নিজের ঋণের বোঝা কমানোর জন্য ভুক্তভোগী এ লোকটি দ্বারস্ত হয়েছিলেন জ্যাকসন হাইটসের এক আইনি প্রতিষ্ঠানের কাছে। আড়াই হাজার ডলার দিয়ে আইনি প্রতিষ্ঠানটি ঋণের ব্যাপারে একটা সুরাহা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন গত পাঁচ বছর থেকে প্রতিষ্ঠানটির পেছনে ঘুরছেন বদরুল ইসলাম। সমস্যার কোন সুরাহা হয়নি। আইনি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনতেও ভয় পাচ্ছেন এ অভিবাসী। জানেনও না , কোথায় এখন প্রতিকারের জন্য যাবেন। নিউইয়র্ক ছেড়ে অন্য শহরে চলে গেছেন বদরুল ইসলাম। ঋণের দায়ও টেনে বেড়াচ্ছেন। বিমর্ষ প্রতিক্রিয়ায় জানালেন, কোথাও অভিযোগ করার তাঁর সামর্থ নেই। গরীবের অভিযোগ কেউ শোনে না। আইনি প্রতিষ্ঠানটির নাম না-প্রকাশ করার জন্যও অনুরোধ করলেন।   

জুলফিয়া নুপুর বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসী। একজন সিঙ্গেল মা হিসেবে এক দশকের বেশি সময় থেকে কুইনসের সানিসাইড এলাকায় থাকেন। কষ্টের অভিবাসী জীবন হলেও অন্য আরও দু'শজন অভিবাসীর মতো জুলফিয়া নূপুরও আমেরিকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তাঁর একমাত্র মেয়েটি বড় হতে থাকে।  টানাপোড়েনের মধ্যেই সংসার চালাচ্ছিলেন জুলফিয়া। এরমধ্যেও কিছুটা সঞ্চয়ের চেষ্টা করে আমেরিকার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। নিজের জন্য একটি মাথা গুজার ঠাঁই হিসেবে সাশ্রয়মূল্যে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনবেন, এমন একটা ইচ্ছে লালন করছিলেন এ সংগ্রামী অভিবাসী নারী।   

 

২০২০ সালের কোভিড মহামারির আগেই জুলফিয়া নুপুর আবিষ্কার করলেন, তিনি বাজার অর্থনীতির বিরাট ফাঁদে পা আটকে গেছেন নিজের অজান্তেই। বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ডে তাঁর দেনা হয়ে উঠেছে ২০ হাজার ডলারের বেশি। মুল অর্থের সাথে যোগ হয়েছে কড়া রেটের সুদ। তারপরও হিসেব মিলাতে পারছিলেন না দিশেহারা এ নারী। ক্রেডিট রিপেয়ার, ক্রেডিট কার্ড পাওনা সমঝোতা করে দেয়ার জন্য একটি জালিয়াত চক্রের হাতে তিনি আরও কিছু অর্থ হারান সমস্যার সমাধান চেয়ে।

 

জ্যাকসন হাইটসের আলট্রা ক্রেডিট সলিউশন নামের প্রতিষ্ঠানে যখন সাহায্যের জন্য আসেন তখন জুলফিয়া নুপুর প্রায় সর্বস্ব হারিয়েছেন, ভয়ে কারও সাথে কথা বলতে পারছিলেন না। ভয় পাচ্ছিলেন, পাওনা অর্থের জন্য তাঁকে কেউ গ্রেপ্তার করবে কি না।

 

আলট্রা ক্রেডিট সলিউশন্স নামের প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী সাব্বির চৌধুরী জীবন। জানালেন, জুলফিয়া নুপুরের মতো এমন বিপন্ন মানুষকে তাঁরা সাহায্য করে থাকেন। সেন্ট জোন্স ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক সাব্বির জানালেন ইউনিভার্সিটি অফ ফিনিক্স থেকে এমবিএ এবং ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি থেকে আইনে ডিগ্রি নেয়ার পর কর্মজীবনে প্রবেশ করেন তিনি। দ্রুতই ধরতে পারেন, নতুন অভিবাসীদের আমেরিকায় ক্রেডিট সমস্যা প্রকট। এ নিয়ে যেমন সচেতনতার অভাব রয়েছে, তেমনি সমস্যায় পড়লে প্রতিকার পাওয়ার জন্য যাওয়ার যথেষ্ট জায়গা নেই। ভাষা সমস্যাসহ নানা কারণে প্রথম আসা অভিবাসীরাই ব্যাপকভাবে ক্রেডিট সমস্যায় পড়ছেন বলে সাব্বির চৌধুরী জানালেন।

 

গত ৮ বছর থেকে কুইনসে বাংলাদেশি কমিউনিটিকে সেবা দিয়ে আসছে আলট্রা ক্রেডিট সলিউশন। তাঁর জ্যাকসন হাইটসের অফিসে যুক্ত রয়েছেন চারজন কর্মচারী। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, আশিক ওসমান নামের কর্মকর্তা একজন ভুক্তভোগীর ক্রেডিট সমস্যা নিয়ে কাস্টমারের সাথে কথা বলছেন। হাবিবুর রহমান নামের এ বাংলাদেশি অভিবাসী কাস্টমার ব্রুকলিনে বসবাস করেন। তাঁর পরিচয় চুরি হয়ে গেছে। সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর ও অন্যান্য পরিচয় চুরি হয়ে যাওয়ার পর জালিয়াতরা হাবিবুর রহমানের নামে ক্রেডিট কার্ড তৈরি করেছে। এখন বাড়ি কেনার সময় গৃহ ঋণ পাচ্ছেন না হাবিবুর রহমান।

 

আশিক ওসমান নিজেও বাংলাদেশ থেকে আইনের ডিগ্রি নেয়া একজন অভিবাসী। জানালেন, আলট্রা ক্রেডিট সলিউশন এসব ক্ষেত্রে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাঁদের ক্লায়েন্টদের সেবা দিয়ে থাকে। তাদের প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আইনজীবীদের মাধ্যমে প্রয়োজনে মামলা করা হয়। ক্রেডিট রক্ষণাবেক্ষণের সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ করা হয়। কখনও সমঝোতা করে, কখনও আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে এসব সমস্যার সমাধান করা হয়ে থাকে। নতুন করে হাবিবুর রহমানের মতো লোকজন যাতে সমস্যায় না পড়েন, এ নিয়ে ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কাজের ধরন অনুযায়ী তাঁরা ক্লায়েন্টের কাছ থেকে সার্ভিস ফি আদায় করে থাকেন বলে জানা গেল।

আলট্রা ক্রেডিট সলিউশনের সিইও সাব্বির চৌধুরী জানালেন, মহামারির পর লোকজনের ক্রেডিট সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। পরিচয় চুরি হওয়া থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক বাস্তবতা এ সমস্যাকে আরও গভীর  করে তুলেছে। গত এক বছরে তিন শতাধিক লোকজনের ক্রেডিট সমস্যা সমাধানে তাঁর প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে। সাব্বির জানান, শুধুমাত্র বাংলাদেশি নয়, গত এক বছরের হিসেবে ৫০ শতাংশের সেবাগ্রহীতা দক্ষিণ এশীয় বা অন্যান্য এলাকার অভিবাসী। 

সাব্বির চৌধুরী জানালেন, নিজের পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ক্রেডিট নিয়ে সমস্যার সবকিছু দেখভাল করার যোগ্যতা রাখেন। শুধুমাত্র ব্যবসায়ী কারণেই নয়, কমিউনিটিকে একটি ব্যতক্রমধর্মী কাজের মাধ্যমে সেবা দেয়াও তাঁর লক্ষ্য।

সমস্যাটি নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশি কমিউনিটির পরিচিত আইনজীবী অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরীর সাথে। ইউএস সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী বলেন, নতুন আসা অভিবাসীরা আমেরিকার ক্রেডিট ব্যবস্থা, এর প্রয়োজনীয়তা- এসব নিয়ে শুরুতেই কোনো ধারণা পায় না। তিনি বলেন, যখন কোনো ঘটনা ঘটে যায় তখন আমাদের কাছে অনেকেই আসেন। আইনগত প্রতিকার পাওয়াও এখানে ব্যয়বহুল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ক্ষতি হওয়ার আগেই লোকজন তাঁদের ভাষায় এ নিয়ে পরামর্শ পেলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো।

মাহবুব রহমান নামের রিয়েল এস্টেট এজেন্ট জানান, সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, অনেকের কাছেই ভালো অংকের নগদ সঞ্চয় রয়েছে। অথচ বাড়ি কেনার জন্য পর্যাপ্ত ক্রেডিট না থাকার কারণে মর্টগেজ পাচ্ছে না। ক্রেডিট সমস্যার কারণে অনেকেরই আমেরিকার স্বপ্ন বাস্তবায়ন থমকে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা একটি ঘরের মালিক হতে পারছে না। এ নিয়ে কমিউনিটিভিত্তিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও এ রিয়েল এস্টেট জানালেন, গত তিন বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলতে পারেন সত্তর শতাংশ বাংলাদেশি বাড়ি ক্রেতাই ক্রেডিট সমস্যার জন্য বাড়ি কেনায় প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করছেন।

আলট্রা ক্রেডিট সলিউশনের সাব্বির চৌধুরী বলেন, আমরা শুধু প্রতিকারই করে দেই না। কীভাবে ক্রেডিট সংরক্ষণ করবেন বা ভেঙ্গে পড়া ক্রেডিট আবার গড়ে তুলবেন, এ নিয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকি। তাঁরা কিছু পেশাগত পদক্ষেপের মাধ্যমে এ নিয়ে ক্লায়েন্টদের সেবা দিয়ে থাকেন বলে জানালেন। নিয়মাতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যার সমাধানে ধৈর্য ধরার জন্য তিনি তাঁর ক্লায়েন্টদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ স্পর্শকাতর সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা সম্পর্কে ক্লায়েন্টদের সতর্ক থাকারও পরামর্শ দিয়ে থাকেন সাব্বির চৌধুরী।  

সবসময় প্রকাশ্যে না আসা এ সমস্যা নিয়ে কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট মঈনুল হক হেলাল বলেন, আমরা কমিউনিটি সংগঠনগুলো অন্যান্য সামাজিক বিষয়কে অগ্রাধিকার মনে করে কাজ করে আসছি। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে ক্রেডিট সমস্যা লোকজনকে সমস্যায় ফেলছে বলে আমরা এখন জানতে পারছি। এ নিয়ে কমিউনিটির অলাভজনক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে পরামর্শমূলক কর্মসুচি চালু করার ব্যাপারে তিনি বিভিন্ন সংগঠনের সাথে আলাপ করবেন বলে জানালেন।

মঈনুল হক বলেন, এক্ষেত্রে কমিউনিটির সংবাদমাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

( This story was produced as part of the Small Business Reporting Fellowship, organized by the Center for Community Media and funded by the NYC Mayor's Office of Media and Entertainment. )