স্বাধীনতার অর্জন ও স্খলন এবং জাতীয়তাবাদীদের আদর্শচ্যুতি
স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাদের একটি বড় অংশ ছিল বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতার বিরোধী। এরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় পূর্ণ স্বাধীনতার বদলে পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন করে থাকার পক্ষেই ঝুকে ছিল। ফলে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সংরক্ষণে সর্বক্ষণ ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রসহ সবধরনের গণমুখী প্রগতিশীল ধারার জাতি দুশমন। এরা প্রকৃত জাতীয়তাবাদী ছিল না, তাই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামেরও বিরোধী ছিল। এদের উচ্চাকাঙ্খা যতো প্রবল ছিল, তত তীব্র ছিল না স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পক্ষে। তবু সব ধরনের সংকট কাটিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হলো। কিন্তু নবীন রাষ্ট্রের নেতৃত্বের চেতনাগত দুর্বলতা প্রকটভাবে প্রকাশ ঘটতে লাগলো। বিজয়ী নেতৃত্বের এই দুর্বলতা বিজিতদের ষ্পর্ধিত করে তুললো।
ষ্পর্ধা এতো বেড়ে গেল যে ’মুসলিম বাংলা’ শ্লোগানে দেশ ভাসিয়ে দিল। অথচ রক্তের মূল্যে অর্জিত বাংলাদেশ একটি অসা¤প্রদায়িক গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে পরিগণিত। তাৎক্ষণিক ’মুসলিম বাংলা জিন্দাবাদ’ শ্লোগান কোনভাবে প্রত্যাশা ছিল না। এর মূল কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র সম্পর্কে নেতৃত্বের আস্তরিকতায় খাদ ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে নবীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কদের সকলেরই স্বচ্ছ ও ষ্পষ্ট ধারণা ছিল না। তাদের বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন সময় এর প্রকাশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ’ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’ এর চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা তারা তুলে ধরতে পারেননি। কখনো বোঝানোর চেষ্টা করেছেন সকল ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা, যেমন সভা সমিতিতে সকল স¤প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ পাঠ। ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি সেকুলাররিজমের প্রতিশব্দ। কিন্তু সেকুলারিজম বলতে আসলে যা বুঝায় নেতারা হয়তো বুঝতেন না বা বুঝেও না বুঝার চেষ্টা করতেন। কিংবা কৌশলগত কারণ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী শক্তির কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তোলার কৌশল হতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো ধর্মীয় রাজনীতির অনুসারীদের ধোঁকা দেয়ার জন্য যদি এমন কৌশল হয়ে থাকে তবে তাদের কৌশল সম্পূর্ণ ব্যর্থ একথা দৃঢ়ভাবে বলা যায়। এবং শুধু ব্যর্থই নয় উল্টো ফল ফলিয়েছে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কিত ফাঁকফোঁকর গুলো বিরোধীরা অতি সন্তর্পনে কাজে লাগাতে পেরেছে। মুুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানী ইসলাম মার্কা ভাবধারা যেভাবে কোণঠাসা হয়েছিল জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের নৈরাজ্য ও অপকৌশলের নৈরাশ্যকর পরিস্থিতি ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে ধর্ম ও ধর্মীয় রাজনীতির ধারাটি শক্তি স য় করতে পেরেছে। এবং একই সাথে তারা জাতীয়তাবাদকেও ব্যবহার করে। পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্বের বদলে ভাষা ভিত্তিক ভৌগলিক নিরিখেই বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হবে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু শত্রুপক্ষ ধূর্ততার সাথে বিভ্রান্তির জাল বিছিয়েছে। তারা প্রশ্ন তুলেছে পশ্চিমবাংলার জনগণও বাঙালী এখন আমরাও যদি বাঙালী হই তাহলে ওদের সাথে আমাদের প্রভেদ রইলো কোথায়? এবং এই সুযোগে ভারত যদি পশ্চিমবঙ্গের সাথে আমাদের মিলিয়ে পুরো স্বাধীনতাটাই হরণ করে নেয়। কাজেই আমাদের বাঙালী হলে চলবে না। তাছাড়া বাংলাদেশের শতকরা ৮৫% ভাগ মুসলমান, ভারতের হিন্দু জাতীয়তা হতে পৃথক থেকে মুসলমানের ইমান আকিদার ভিত্তিতে আমাদের জাতীয়তা চিন্তা করতে হবে। অর্থাৎ এই সুযোগে তারা সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানী ভাবধারার পোশাক বাঙালী জাতীয়তার গায়ে পরিয়ে দিল।
ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের মতো সমাজতন্ত্রকে ঘিরেও ছিল চরম অস্পষ্টতা ও অস্বচ্ছতা। শুধু অষ্পষ্টতাই নয় বিরোধীদের বিরোধীতার লক্ষ্যই ছিল সমাজতন্ত্র। এবং বিরোধিতা শুধু স্বাধীনতাবিরোধীর পক্ষ থেকেই আসেনি। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভিতরেও ছিল অর্থ-বিত্তে প্রভাবশালী একটি মহল। এরা পাকিস্তানী দাদা, আদমজী, বাওয়ানীর কাছে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার নিস্পেষনে খাঁটি বাঙালী বনে যায়। বাঙালীত্বের অভিমান তাদের ছিল বটে তবে চাষি-মজুর, শ্রমিকদের দর্শন সমাজতন্ত্রকে মেনে নেবে এটা ভাবা যায় কি করে। তাই বাংলাদেশকে তাদের শোষণের অভয়ারণ্য করে তোলার উদ্দেশ্যেই তারা মুক্তিযুদ্ধে শরীক হয়েছিল এর বেশি নয়।
ফলে মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যখন সমাজতন্ত্র অন্যতম মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহন করলো তারা তখন দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে। তাই স্বাধীনতার পরবর্তীতে তারা স্বমূর্ত ধারণে অবতীর্ণ হলো। অপরদিকে জাতীয়তাবাদী দলটির মধ্যে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আন্তরিক ছিলেন কিংবা আন্তরিকভাবে হয়তো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কামনা করতেন কিন্তু সমাজতন্ত্রী শ্রেণীচরিত্র বা তত্ত্বজ্ঞান কোনটাই তাদের ছিল না। ফলে শত্রুপক্ষ সুযোগ নিয়েছে এই দুর্বলতার।
বাকি রইলো গণতন্ত্র। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিতে গণতন্ত্রের কোন ছিটেফোঁটাও ছিল না। জন্মলগ্ন থেকেই সামারিক-অসামরিক স্বৈরতন্ত্রের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। সেই স্বৈরতন্ত্রের নিষ্পেষণ সারা পাকিস্তানকেই নিস্পেষিত করেছে, তবে পুর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিশেষভাবে নিষ্পেষিত হয়েছে। তাই পুর্ব পাকিস্তান থেকেই গণতন্ত্রের আওয়াজ জোরালো হয়ে ওঠে। সেই আওয়াজই শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত পৌছে দিয়েছে। যার ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা লাভ। সেই স্বাধীন রাষ্ট্রটি গণতন্ত্র অনুসারে চালিত হবে তা নিয়ে কোন বিতর্ক ওঠার কথা ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার পর পরই গণতন্ত্র নিয়ে নানা কুটচাল শুরু হয়ে যায়।
স্বাধীনতাকে কন্টকমুক্ত রাখা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার প্রয়োজনেই স্বাধীনতা বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকার নাকচ করা হয়েছিল, ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন ও রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তবু সংবিধানে এরূপ বিধান গণতন্ত্র সম্মত কিনা স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র অতি সন্তর্পনে প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু প্রশ্নটির উত্তর তাৎক্ষণিক কোন মহল দেননি বা দিতে চাননি। যারা সংবিধান প্রণেতা বা যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন ব্যাখ্যা বা উত্তরের দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবে তাদের ওপরই বর্তায়। কিন্তু সে দায়িত্ব তারা যথাযথ পালন করেননি বা করতে পারেননি। অধিকন্তু তাদের নিজেদের আচরণই গণতন্ত্রহীনতা মূর্ত হয়ে উঠেছিল। তারা ক্ষমতার সদ্ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহারই বেশি করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অধীনে ১৯৭৩-এ যে নির্বাচন হয় তাতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত ছিল। সেক্ষেত্রে বিরোধীদের ৩০/৪০টি আসন দিলে শাসক দলের ক্ষতি হতো না বরং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উদারতার জন্য মানুষের কাছে শ্রদ্ধায় নন্দিত হতেন।
কিন্তু নন্দিত হওয়ার সুযোগ তো গ্রহণ করলেন না। অধিকন্তু নির্বাচনে অনভিপ্রেত আচরণ করে নিজেদের গায়ে অনাবশ্যক কলঙ্কের দাগ লাগালেন। অনেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামলেন, অনেক ক্ষেত্রে বিরোধী প্রার্থীকে মনোনয়ন জমা দিতে দিলেন না, অনেক পরাজিত হয়েও নির্বাচিত হওয়ার তেলেসমাতি দেখালেন। তাজউদ্দিনের ন্যায় বিবেকবান গণতন্ত্রপরায়ন লোক ব্যাপারটিকে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু ঠেকাতেও পারেননি। কারণ আগেই তখনকার ক্ষমতার মে অধিষ্ঠিত বিবেকবান দায়িত্ববান মানুষেরা চক্রান্তের জালে শক্তিহীন হয়ে পড়েছেন। আর শক্তিমান ক্ষমতাধর অংশটি ক্ষমতার দাপটে দিগি¦দিক জ্ঞান শূন্য হয়ে আত্মঘাতি আচরণে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
১৯৭৩ সালের পহেলা জানুয়ারী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ভিয়েতনামের প্রতি সংহতি সমাবেশে পুলিশ গুলি বর্ষণ করলে দু’জন ছাত্রনেতা নিহন হন। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র বিরোধী চক্রের শক্তি ও প্রতাপের প্রকাশ ঘটলো। শাসক গোষ্ঠির অভ্যন্তরে গণতন্ত্রবিরোধী এই শক্তিটি সুস্থ গণতান্ত্রিক চিন্তা ও আন্দোলনকে প্রতিনিয়ত গলাটিপে ধরেছে। কিন্তু তাই বলে কট্টর স্বাধীনতাবিরোধীদের গায়ে একটি আঁচড়ও ধরাতে পারেনি। বরং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এধরনের গণতন্ত্রহীনতার সব সুবিধাই গ্রহণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে তারা প্রশ্নবিদ্ধ করে জনগনকে বলতে সাহস পেয়েছে, ’এর চেয়ে পাকিস্তান আমলেই আমরা ভালো ছিলাম।’
এভাবেই ধ্বসে গেল রক্ত ঋণে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানের স্তম্ভগুলো। এরই স্বাভাবিক পরিণতি রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিও পাকিস্তানী করণের সূত্রপাত এবং আজকে তাদের ক্ষমতার অংশিদারিত্ব লাভ। ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৫ বছর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে যে সুযোগ ও পরিবেশ তৈরি হয়েছিল পচাঁত্তরের পরবর্তীতে মৌলবাদ ও মৌলবাদী স্বৈরশাসনে উত্থান ও শাসন ক্ষমতা আরো কঠিন করে তুলেছে। জাতীয়বাদীদেরও এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গণতন্ত্রের মুখোশধারী সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীলতা অতীতের চেয়ে আরো স্পষ্ট এবং বৃদ্ধি পেয়েছে। দলীয় মেনিফেষ্টোতে ধর্মনিরপেক্ষতার গায়ে নতুন ব্যাখ্যা সংযোজন করে নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ অনেকে ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে ধর্মীয় লেবাস পরিয়ে দিতে প্রয়াস পাচ্ছেন। মাথায় পট্টি পরে ঘন ঘন ওমরাহ পালনের ছবি প্রচার করে ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রমানের চেষ্টা হচ্ছে। এটাও অতীতের ন্যায় কৌশল কিনা অথবা কৌশল হয়ে থাকলে আদৌ ফলপ্রসু কিনা জানিনা তবে কৌশলের ধারাবাহিকতায় নিজেরাই মৌলবাদী মনমানসিকতার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়ছেন এটা বলা যায়।
তাই পঁচিশ বছরের আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে পাওয়া গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার অর্জন ধরে রাখা গেলনা। পরবর্তীতে বিশ বছরের ঘাত প্রতিঘাতের পর ’৯৬-এ ক্ষমতায় গিয়েও পঁচাত্তরপূর্ব ভুলের সংশোধন হলো না। এমনকি ২০০৮ সালে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়ে ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকেও সে পথে তারা এগুলো না। আজকে বায়ান্নতম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ক্ষমতার লড়াই আদৌ ফলপ্রসু হলে অতীত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবেনা এরকম নিশ্চয়তা কতটুকু। তথাপি মানুষ আশায় বুক বেঁধেই হয়তো সংগ্রাম করছে। মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস, সামনে বায়ান্নতম বিজয় দিবস, এ দিবসই হোক আশার আলো ও সকল হারানো প্রাপ্তির বিজয় উৎসব।